বাড়িটা অদ্ভুত রকমের সুন্দর। কোলাহল থেকে দূরে গাছগাছালিতে ভরপুর। অনেক জায়গা নিয়ে থাকা এ বাড়িতে থাকতে শাহের এর ভালোই লাগছে। বয়স ত্রিশ এর কাছে হলেও পুরো বৃদ্ধের মতন ওর বাস। সারাদিন এ বাড়ির আশেপাশেই থাকে। তবু এখনও চিনে নিতে পারেনি। ঠিক কি কারণে এখানে পড়ে থাকা তাও ঠিক ওর জানা নেই। সকালের রোদের ছোঁয়া আর পাখির ডাকে পুরো অভ্যস্ত শাহের। বিকেলে উঠনে বসে বই পড়তে পড়তেই সন্ধ্যা গড়িয়ে আসে। এরপর নিজের সাথেই যত কথা। বই এর পাতাগুলো খুব চেনা। ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ হয়ে এলো। চারপাশের নিস্তব্দতা শাহের কে জাগালো না। খানিক পরে চোখের পাতা খুলতেই হচকচিয়ে গেলো। ‘কে আপনি?’ ‘ভূত’ ‘……’ ‘হহাহাহাহাআহাহহা’ মেয়েটা কে ছিল শাহের জানে না। তার কথা ভেবে আর নিজের সাথে কথা বলা হলো না। মেয়েটি থাকলে ভালো হত। দু’টো কথা বলা যেতো। পরিচিত হবার সুযোগটাও পাওয়া যেতো। কিছুই না বলে চলে যাওয়াটা শাহের এর পছন্দ হয়েছে। এ বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই। মোমের আলোয় মেয়েটার ছবি ঠিক কল্পনা করা গেলো না। শাহের এ নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামালো না। চেয়ারে আরাম করে বসতেই গিটার এর সুর। শাহের উঠে তাকাতেই থেমে গেলো। মেয়েটার ভাবনা সব গুলিয়ে দিয়েছে। এবার চোখটা বন্ধ করতেই একই সুর। শাহের উঠে গেলো। হয়তো কেউ এসেছে। না! কোথাও কেউ নেই। শাহের এর চিন্তা হতে লাগলো। সুরটা থেমে গেছে। ‘কি করেন?’ ‘কাল ওভাবে চলে গেলেন কেনো?’ ‘এই বুঝি আপনার উত্তর হলো?’ ‘বই পড়ি’ ‘পাতাগুলো খুব চেনা?’ ‘আপনি কি করে জানলেন’ ‘জানি জানি’ ‘ভিতরে আসুন’ ঝুম বৃষ্টিটা কথা শেষ হতে দিলো না। কথা বলার ইচ্ছেটা সে বুঝে নিলে সুবিধে হত। সে চুপ করে বসে রইল। বৃষ্টি থামার কোনো ইশারা না দেখে তার মধ্যে অস্বস্তি নেই। মোমের আলোয় তাকে দেখে শাহের মন ভরে গেলো। এভাবেই থেকে গেলে মন্দ নয়। ‘ঐ ঘরটা তে কে থাকে?’ ‘বলতে পারবো না। আসার পর থেকে বন্ধই দেখেছি।’ ‘খুলতে ইচ্ছে হয় নি?’ ‘তা নিয়ে কখনো ভাবিনি। এখানে কেউ গিটার বাজায়? সুর টা?’ ‘এক জন বাঁজায়। আরেক জন শোনে। ওরা দু’জন খুব চেষ্টা করছে। মাঝে মাঝে বাঁজায়।’ ‘কারা? কি চেষ্টা করছে?’ ‘এতো জেনে কি করবেন? ওরাও জানতে চায়।’ ‘হাসালেন। আপনার নামটা?’ ‘ঈশিতা…ঈশিতা বিনতে হক’ ‘আমি শাহের’ ‘জানি’ ‘কিভাবে?’ ‘বলবো…সব বলবো’ গিটারের সুর পাগল করে দিয়েছে। মেয়েটির জন্য অপেক্ষা করছে সে। বৃষ্টি থামার সাথেই চলে যাওয়াটা পছন্দ হয়নি শাহের এর। সুর এর শেষটাও খুঁজে নিতে পারছে না। বাড়ির পিছনে চলে এসেছে। ওদিকে আগে যাওয়া হয়নি। কিছুটা সামনে যেতেই পাথর এ লেগে পড়ে গেলো শাহের। কিছু একটা লেখা সেখানে। ভালো করে তাকাতেই লেখাটা পরিষ্কার হয়ে এলো – “ঈশিতা বিনতে হক (১৮৭৭ – ১৯০১)” সব গুলিয়ে গেছে। কোনো রকমে উঠে এসেছে সে। বাড়ির দরজা বন্ধ করে আটকে যাওয়া সময়টাকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছে। হয়তো যা দেখেছে সব ভুল ছিল। সব দোষ ভেসে আসা সুর এর। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে শাহের এর। নিজেকে সামলে নিয়ে ঘরটার দিকে এগিয়ে গেলো। ভেতরটা অন্ধকার। পর্দা সরিয়ে নিতেই আলোটা চলে এলো। হালকা আলোয় অস্পষ্ট ছবিতে তাকাতেই সব পরিষ্কার হয়ে গেলো। কেউ ডাকছে। শাহের কিছু ভেবে উঠতে পারছে না। ছবির মানুষটা কে কাল-ই সে চিনেছে। সব ভুলে জানালায় যেতেই আঁতকে উঠলো। কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না। যতদূর সম্ভব পিছিয়ে গেছে শাহের। ‘ভয় পেয়ো না। আমি তোমার জন্য এসেছি।’ ‘চলে যাও এখান থেকে।’ ‘কখনো কখনো সব মেনে নিতে হয়। নিজেকে সামলে নেও।’ ‘চলে যাও আমার বাড়ি থেকে।’ ‘ওরা তোমাকে থাকতে দেবে না।’ ‘এটা আমার বাড়ি’ ‘একবার দেখো’ পাশের ঘরে ধোঁয়া বেড়ে গেছে। শাহের ছুটে গেলো সেদিকে। ওরা দু’জন বসে আছে। শাহের চিৎকার করে উঠলো। ‘এটা আমার বাড়ি। চলে যাও। চলে যাও তোমরা। এটা আমার বাড়ি। আমি বেঁচে আছি এখনো। চলে যাও।’ হাতের কাছে পেয়ে গ্লাসটা ছুঁড়ে মারলো শাহের। এভাবে গ্লাস এর ছুটে আসা অবাক করে দিলো সোহেলকে। রায়হান ভয়ে আঁতকে উঠলো। নিজের স্ত্রী কে মেরে সে যে এ বাড়িতেই আত্মহত্যা করেছে এ ব্যাপারে আর কোনো সন্দেহ নেই তাদের। প্ল্যানচেট থামিয়ে দু’জনেই বেরিয়ে গেলো বাড়িটা থেকে। সোহেল মনে করে নিয়ে নিলো তার গিটার। শাহের কাঁদছে। ঈশিতা শাহের কে সান্ত্বনা দিয়ে থামালো। ‘কেঁদো না।’ ‘আমি তোমাকে মারতে চাইনি।’ ‘ছেঁড়ে দেও।’ ‘আমায় ছেঁড়ে যেয়ো না।’ ‘না আমাকে যেতে হবে। তুমি থাকো।’ ‘না’ ‘তোমাকে থাকতে হবে।’ ‘একা?’ ‘হ্যাঁ……একা’
ইমেইলে নতুন লেখাগুলো পেতে সাইন আপ করুন 🙂
অচ্যুত সাহা জয়
"কখনো কোনো পাগলকে সাঁকো নাড়ানোর কথা বলতে হয় না। আমরা বলি না। আপনি বলেছেন। এর দায়দায়িত্ব কিন্তু আর আমার না - আপনার!"