গাজরের উপকারিতা – পুষ্টিকর কিন্তু এড়িয়ে যাওয়া এক সবজি
গাজর দেখতে অনেকটা কমলা রঙের মুলার মত। আকর্ষর্ণীয় রঙ ও স্বাদের জন্য ছোট বড় সবার কাছেই এই সবজিটি জনপ্রিয়।
গাজর স্বাদে অত্যন্ত সুস্বাদু, পুষ্টিকর এবং আঁশসমৃদ্ধ শীতকালীন সবজি, যা প্রায় সারা বছরই পাওয়া যায়। কাঁচা ও রান্না দু’ভাবেই এটি খাওয়া যায়। তরকারী ও সালাদ হিসাবেও গাজর অত্যন্ত জনপ্রিয়।
গাজর অতি পুষ্টিমান সমৃদ্ধ সবজি যা আমাদের শরীর ও ত্বক দুটির জন্যই খুবই উপকারী।। এতে উচ্চমানের বিটা ক্যারোটিন, ভিটামিন এ, মিনারেলস ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আছে। তবে এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে উপকারটি হ’ল দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি পাওয়া।
গাজরের পুষ্টিমান
প্রতি ১০০ গ্রাম গাজরে রয়েছে
- খাদ্য শক্তি- ৪৮ ক্যালোরি
- শর্করা- ১০.৬০ গ্রাম
- খনিজ পদার্থ- ১.১০ গ্রাম
- ক্যালসিয়াম- ৮০.০০ মি. গ্রাম
- ফসফরাস- ৫৩০.০০ মি. গ্রাম
- লৌহ- ২.২০ মি. গ্রাম
- ক্যারোটিন- ১৮৯০.০০ মাইক্রোগ্রাম
- ভিটামিন বি ১ – ০.০৪ মি. গ্রাম
- ভিটামিন সি- ৩.০০ গ্রাম ।
গাজর শীতকালীন সবজি হলেও প্রায় সারা বছরই পাওয়া যায়। গাজরের পুষ্টিমান ও উপকার পুরোপুরি পেতে কাঁচা বা আধসেদ্ধ অবস্থায় খান। সেদ্ধ করে বা রান্না করে পানি ফেলে দেবেন না। চলুন জেনে নেওয়া যাক গাজরের উল্লেখযোগ্য কিছু উপকারিতা।
দৃষ্টি শক্তির ঔষধ
গাজরের আকর্ষণীয় সব উপকারী দিকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল দৃষ্টি শক্তিতে সহায়তা দেওয়া। লাল-কমলা রঙের ফল-মূল অথবা সবজি যেমন গাজর, মিষ্টি কুমড়া এবং তরমুজে বেটা-ক্যারোটিন নামের এক ধরনের উপাদান থাকে। এই উপাদানটি শরীরে ভিটামিন ‘এ’-তে পরিণত হয়।
গাজরের বিটা ক্যারোটিন নিজে নিজেই ভিটামিন-এ’তে রূপান্তরিত হয় । যা দৃষ্টিশক্তির উন্নতিতে ভূমিকা রাখে। বিটা-ক্যারোটিন আমাদের দেহের ভেতরে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে রেটিনল বা ভিটামিন-এ’তে রূপান্তরিত হয়, আর ভিটামিন-এ আমাদের দৃষ্টিশক্তি স্বাভাবিক রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আমাদের দেশে প্রতি বছর ভিটামিন-এ’র অভাবে ৩০ থেকে ৪০ হাজার শিশু অন্ধ হয়ে যায় । সাধারণত ৫ মাস থেকে ৫ বছর বয়সের শিশুরাই চোখের সমস্যায় বেশি ভোগে। প্রতি বছর প্রায় ৫ লাখ শিশু রাতকানা রোগে আক্রান্ত হয়। তাই শিশুকে নিয়মিত ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ানো উচিত। গাজরে প্রচুর ক্যারোটিন থাকে। ক্যারোটিন ভিটামিন এ এর উৎস বলে শিশুদের অন্তত মৌসুমের সময় প্রতিদিন গাজর খাওয়ানো উচিত।
ক্যান্সার প্রতিরোধে গাজর
হজম প্রক্রিয়া শেষে খাদ্যের যে উচ্ছিষ্টাংশগুলো আমাদের শরীরে থেকে সেগুলোকে ফ্রি র্যাডিকেলস বা মৌল বলে। এই ফ্রি র্যাডিকেলস শরীরের কিছু কোষ নষ্ট করে থাকে।
অ্যান্টি অক্সিডেন্ট জাতীয় খাবার এই ধরনের মৌলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। এর ফলে, শরীরে ক্যান্সারের কোষ জন্ম নেওয়ার প্রবণতা অনেকাংশে কমে যায়। গবেষণায় দেখা যায়, প্রতি ১০০ গ্রাম গাজরে ৩৩ শতাংশ ভিটামিন ‘এ’, ৯ শতাংশ ভিটামিন ‘সি’ এবং ৫ শতাংশ ভিটামিন ‘বি-৬’ পাওয়া যায়। এগুলো একত্র হয়ে ফ্রি র্যাডিকেলসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।
গাজরে বিদ্যমান বিটা-ক্যারোটিন আমাদের ত্বককে সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মির হাত থেকে সুরক্ষা করে। আরো রয়েছে ভিটামিন ই। আর ভিটামিন ই ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক।
সমীক্ষায় দেখে যে গাজর ব্রেস্ট ক্যান্সার, কোলন ক্যান্সার ও ফুসফুসের ক্যান্সারের মতো ক্যান্সার প্রতিরোধ করার ক্ষমতা রাখে। গাজরে বিদ্যমান ফ্যালক্যারিনল ও ফ্যালক্যারিডিওল ফুসফুস ও অন্ত্রের ক্যান্সারসহ অন্যান্য ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। প্রতিদিন অন্তত একটি করে গাজর খাওয়ার হয়ত আপনাকে ক্যান্সারের মতো মারাত্মক রোগ থেকে দূরে রাখবে।
কোলেস্টরল কমায়
গাজরে প্রচুর পরিমাণে আঁশ বা ফাইবার রয়েছে । আর এই ফাইবারে থাকে পেপটিন নামক উপাদান যা রক্তের কোলেস্টেরল কমাতে সহায়তা করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিদিন এক কাপ করে গাজর অন্তত তিন সপ্তাহ খেলে সুফল পাওয়া যায়।
সুন্দর ও সুস্থ্য সবল দাঁত
সুন্দর ও সুস্থ সবল দাঁত কার না পছন্দ। তাহলে গাজর খাওয়া শুরু করে দিন। গাজর আপনার দাঁত ও মুখ গহ্বর পরিষ্কার রাখে। গাজর মুখের প্ল্যাক ও খাবারের উপাদান মুখ থেকে দূর করে টুথ পেস্ট ও টুথ ব্রাশের মতই। এছাড়াও গাজরের মিনারেলগুলো অনেকাংশেই দাঁত মজবুত থাকতে সাহায্য করে।
এছাড়াও চিবিয়ে গাজর খেলে মুখে বেশি পরিমাণে থুতু তৈরি হয় যা মুখ পরিষ্কার রাখে। গাজর অ্যালক্যালাইন হওয়ায় মুখের ভেতরের অ্যাসিড লেভেল ঠিক থাকে যা মুখের মধ্যে ব্যাকটেরিয়া গ্রোথ হতে দেয় না।
হৃদরোগের উপকারী এজেন্ট
হৃৎপিণ্ডের নানা অসুখে এটি খুব ভাল কাজ করে। এর ক্যারোটিনয়েডগুলো হৃৎপিণ্ডের নানা অসুখের ওষুধ হিসেবে কাজ করে। যেসব খাবারে যেমন গাজরে উচ্চমাত্রাই এই উপাদান পাওয়া যায় সেসব খেলে হৃৎপিণ্ডের রোগের ঝুঁকি অনেক কমে আসে। তাই আপনি যদি গাজর শুধু শুধু চিবিয়েও খেতে পারেন তাতেই আপনার হৃদরোগের বিরুদ্ধে বেশ ভালো একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়ে গেল !
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা পরিচালিত সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা সপ্তাহে ছয়টির বেশি গাজর খান তাদের স্ট্রোকের ঝুঁকি যারা এর থেকে কম পরিমাণে কম বা একটি গাজর খাচ্ছেন তাদের তুলনায় অনেক কম হয়। তাই স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে খাবারের তালিকায় গাজর যুক্ত করতে পারেন। এক্ষেত্রে সালাদ বা তরকারিতে ব্যবহার করে খেতে পারেন।
মস্তিষ্ক ক্ষয় রোধ
গাজর মেমোরি লস বা স্মৃতিশক্তি হ্রাসের প্রবণতার গতিকে কমিয়ে দেয়। গবেষণায় বিশেষজ্ঞগণ দেখেছেন সেন্ট্রাল নার্ভস সিস্টেমে বিটা ক্যারোটিন এজিং প্রক্রিয়াকে থামিয়ে দেয়। হারভার্ড স্ট্যাডিতে উল্লেখ করা হয়েছে যদি কেউ দৈনিক ৫০ গ্রাম বিটা-ক্যারোটিন আহার করে তবে মস্তিষ্ক ক্ষয় হ্রাস পায়।
ওজন কমাতে সহায়ক
ওজন কমাতে আমরা কতশত ডায়েট চাট ও খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করে চলি। কিন্তু ওজন কমানোর জন্য আপনি যদি গাজর ডায়েট হিসেবে বেছে নেন তাহলে আপনার ওজন কমানোর ঝামেলা অনেকখানিই কমে যাবে।
গাজর কম ক্যালরি যুক্ত ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ সমৃদ্ধ একটি সবজি যা কাঁচা খাওয়া যায়। কেটে টুকরো করে এমনি বা সালাদ তৈরি করে নাস্তা হিসেবে গাজর খাওয়া যায়। এটি খাবার পরে বেশ কিছুক্ষণ পেট ভরা থাকে বলে ক্যালরিযুক্ত অন্য কোন খাবার খেতে হয় না। যে কারনে এটি ওজন কমাতে সহায়ক হিসেবে কাজ করে। হালকা খিদা ভাব হলে তাই আজেবাজে জিনিস না খেয়ে একটা গাজর খান।
এন্টিসেপ্টিকের কাজ করে
গাজর ভাল অ্যান্টিসেপ্টিক হিসেবেও কাজ করে। প্রায় সময়ই আমাদের শরীরের কোথাও কেটে ছিঁড়ে গেলে ইনফেকশন বা সংক্রমণ হয়ে যায়। এই সংক্রমণ রোধে গাজর খুব কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। শরীরে কোনো ক্ষত হলে তা ইনফেকশন হওয়া থেকে রক্ষা করে। কোথাও কেটে বা পুড়ে গেলে সেখানে কুচি করা গাজর বা সিদ্ধ করা গাজরের পেস্ট লাগিয়ে দিন । আপনার ইনফেকশন হওয়ার আশঙ্কা থাকবে না।
পেটের পীড়া
গাজরে বিদ্যমান থাকা ভিটামিন এ লিভারে গিয়ে শরীর থেকে নানা ধরনের টক্সিন জাতীয় উপাদান পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। এছাড়াও লিভার থেকে অতিরিক্ত চর্বি সরিয়ে ফেলতে সাহায্য করে। সেই সঙ্গে গাজরের ফাইবার কোলন পরিষ্কার রাখে এবং কোষ্ঠকাঠিন্যর হাত থেকে আপনাকে রক্ষা করে।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধে
গাজরের বিটা-ক্যারোটিন ডায়াবেটিস প্রতিরোধেও সহায়ক। যাদের শরীরে বিটা-ক্যারোটিনের আধিক্য রয়েছে তাদের ইনসুলিন লেবেলও ৩২ ভাগ কম হয়।
রোধ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি
প্রতিদিন এক গ্লাস গাজরের জুস শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। শরীরে ক্ষতিকর জীবাণু, ভাইরাস এবং বিভিন্ন ধরনের প্রদাহের বিরুদ্ধে কাজ করে। গাজরের জুসে ভিটামিন ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের খনিজ, পটাশিয়াম, ফসফরাস ইত্যাদি থাকে যা হাড় গঠনে সহায়তা করে।
অ্যাথেরোসক্লেরোসিসের বিরুদ্ধে লড়ে
গাজরে থাকা পটাশিয়াম রক্তের প্রবাহ ঠিক রাখতে সাহায্য করে যার ফলে রক্ত ঠিক ভাবে প্রবাহিত হতে পারে এবং রক্ত জমাট বেধে অ্যাথেরোসক্লেরোসিস হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
হাড়ের সুস্থতায়
ক্যালসিয়ামের একটি ভালো উৎস হওয়ার কারনে গাজর হাড়কে শক্তিশালী করতে সাহায্য করে। এছাড়া লিগামেন্টের সুস্থতায়ও এর ভালো ভূমিকা রয়েছে। এ কারনে গাজর খাওয়া খুব ভাল একটি অভ্যাস।
বার্ধক্য দূরে রাখে
এটি আমাদের জন্য এন্টি এজিং উপাদান হিসেবেও কাজ করে। তাই যদি বয়স ধরে রাখতে চান তাহলে আজ থেকেই গাজর খাওয়া আরম্ভ করে দিতে পারেন | এতে রয়েছে বেটা ক্যারোটিন যা আমাদের শরীরের ভেতরে গিয়ে এন্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে আমাদের শরীরের ক্ষয়প্রাপ্ত কোষগুলোকে ঠিকঠাক করে যা সাধারণত মেটাবোলিজমের কারনে হয়ে থাকে।
এছাড়াও এটি এজিং সেলগুলোর গতি ধীর করে দিতে সাহায্য করে, ফলে আপনি বেশি সময় ধরে বার্ধক্যকে দূরে রাখতে পারবেন। এছাড়াও এতে উপস্থিত ভিটামিন সি কোলাজেন উৎপাদন বাড়িয়ে দেয় | এই কোলাজেন ত্বকের ইলাস্টিসিটি বা বজায় রাখে ফলে ত্বকে বলিরেখা‚ রিঙ্কল হতে দেয় না |
ত্বকের উন্নতি ঘটায়
ভিটামিন ‘এ’ আর বিভিন্ন অ্যান্টি অক্সিডেন্ট থাকায় ত্বকের জন্য গাজর খুব ভালো। এছাড়াও সূর্যের ক্ষতিকারক রশ্মির থেকেও ত্বককে বাঁচায় গাজর। নিয়মিত গাজর খেলে ত্বক নরম এবং উজ্জ্বল হবে। সঙ্গে সঙ্গে উজ্জ্বল ত্বক পেতে অল্প একটুখানি গাজর গ্রেট করে তাতে অল্প মধু মিশিয়ে মুখে‚গলায় এবং হাতে লাগিয়ে নিন। শুকিয়ে গেলে দিয়ে ধুয়ে নিন।
চুল পরা কমায়
গাজরে ভিটামিন ই এবং সি তে ভরপুর। তাই এটি মাথার তালুর রক্ত চলাচল বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে চুল পরা কমাতেও সাহায্য করে।
ত্বকের শুষ্কতা দূর করে
গাজরে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং পটাশিয়ামের মতো খনিজের উপস্থিতি। এই উপাদানগুলো ত্বককে সুস্থ এবং সতেজ রাখতে সহায়তা করে। এসব পুষ্টি উপাদান ত্বক শুকিয়ে যাওয়া, স্কিন টোনকে উন্নত করা এবং ত্বকে দাগ পড়া থেকে রক্ষা করে।
তাই সুন্দর ত্বকের জন্যও গাজর খেতে পারেন। এটি আপনার ত্বককে ভেতর থেকে সুন্দর করে তুলতে সাহায্য করবে। একই সাথে ত্বকে অযাচিত ভাঁজ পড়া, কালো দাগ, ব্রন, ত্বকের রঙের অসামঞ্জস্যতা ইত্যাদি দূর করে আপনাকে সুন্দর হয়ে উঠতে সহায়তা করে।
গাজর ব্যবহারে সতর্কতা
গাজর শুধুমাত্র উপকারই করে না। তাই কিছু ক্ষেত্রে গাজর ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। যাঁরা নিয়মিত ওষুধ সেবন করেন, তাঁদের জন্য গাজরের রস সেবনে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। কারণ এতে যকৃতে টক্সিক উপাদান তৈরি হতে পারে। তাই ওষুধ সেবনের দুই থেকে তিন ঘণ্টা পর গাজর খাওয়া উত্তম।
গাজরের নানা উপকারিতার কথা আমাদের জানা হল । একটু ভাল থাকার জন্য আমরা অনেক চেষ্টাই তো করি।এখন যদি একটি খাদ্য উপাদান আমাদের দৈনন্দিন খাবারের তালিকায় যোগ করে নিজেদের আর একটু ভাল রাখতে পারি তাহলে তা কেন করব না? তাই আসুন নিয়মিত গাজর খাই এবং নিজেকে সুস্থ্ রাখি ।