ছারপোকার উপদ্রব থেকে বাঁচার উপায় ও কামড়ালে করণীয়
ছারপোকা চিনে না এমন মানুষ হয়ত খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ছারপোকার ইংরেজী bed bug । এটি সিমিসিডে গোত্রের একটি ছোটা পোকা। এটি সাধারণত ৪-৫ মিমি বড় হয় যা প্রায় একটি আপেলের বিচির মত । অনেক সময় অনেকে একে ছোট তেলাপোকা বলে ভুল করেন। এর পাখাগুলো উলম্ব আকৃতির তাই এরা উড়তে পারে না। উড়তে না পারলেও এরা খুব দ্রুত হামাগুড়ি দিতে পারে । এরা মানুষ ও অন্যান্য প্রাণির রক্ত খেয়ে বেঁচে থাকে। এরা আমাদের অজান্তে আমাদের রক্ত চুষে খায়। ছারপোকা সারা বিশ্বেই দৃষ্টিগোচর হয়। ৭০-৮০ ফারেনফাইট তাপমাত্রা এদের জন্যে আদর্শ। এই তাপমাত্রায় খুব দ্রুত এরা বৃদ্ধি লাভ করে এবং বছরে তিনবার প্রজননে অংশ গ্রহণ করে।
ছারপোকার বাসস্থান
ছারপোকা সারা বিশ্বেই দেখা যায়। আমেরিকাতে ২য় বিশ্ব যুদ্ধের পূর্বে খুব বেশি দেখা গিয়েছিল বলে জানা। ১৯৪০-১৯৫০ এর দিকে পেস্ট কন্ট্রোল হিসেবে ডিডিটি ব্যবহার শুরু হলে ছারপোকার উপস্থিতি কমে আসে। আর ছারপোকা সহজেই এক দেশ থেকে অন্য দেশে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সম্প্রতি পুনরায় উল্লেখযোগ্য হারে ছারপোকার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
ছারপোকা ঘরের যে কোন স্থানে বসবাস করতে পারে তবে বিশেষ করে দুর্বল স্যানিটেশন যুক্ত স্থানে এদের বেশি দেখা মিলে। বিছানায় বেশী দেখা গেলেও ছারপোকার অন্যতম পছন্দের জায়গা হল ম্যাট্রেস, সোফা এবং অন্যান্য আসবাবপত্র। এ পোকাটি বিছানা, মশারি, বালিশের এক প্রান্তে বাসা বাঁধলেও ট্রেন কিংবা বাসের আসনে ও এদের সরব উপস্থিতি দেখা যায়।
ছারপোকার খাদ্য ও আচরণ
ছারপোকা শুধু মাত্র রক্ত খেয়ে বেঁচে থাকে। হোক সেটা মানুষ কিংবা অন্য কোন প্রাণীর। ছারপোকা বেশি গরম সহ্য করতে পারে না তাই গরমের দিনে এদের বেশি দেখা যায়। ঠান্ডা আবহাওয়ায় এরা কোন খাবার ছাড়াই প্রায় এক বছর বেঁচে থাকতে পারে ! সাধারনত এরা রাতের বেলায় যখন হোস্ট ঘুমিয়ে থাকে তখন সক্রিয় হয় এবং রক্ত পান করে থাকে।
ছারপোকা থেকে বাঁচার উপায়
ঘরে ছারপোকার আক্রমণ ঘটলে অশান্তির অন্ত থাকে না। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের হলসহ বাসা-বাড়িতেও এখন ছারপোকার যন্ত্রনা।
একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ছারপোকারা কীটনাশক সহ্য করার ক্ষমতা আগের তুলনায় প্রায় ৫০ গুণ বৃদ্ধি পয়েছে৷ বেশি কিছু প্রজাতির ছারপোকার ওপর গবেষণা শেষে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এদের ধ্বংস করতে হলে আগে যে কীটনাশক ব্যবহার করতে হতো, সে কীটনাশকে তেমন কাজ হয় না বরং এদের ধ্বংশ করতে কীটনাশকের শক্তি আগের চেয়ে হাজার গুণ বৃদ্ধি করতে হয়। কারন হিসেবে বলা হয়েছে ছারপোকার ১৪টি জিনে বেশ পরিবর্তন এসেছে ফলে এদের চামড়া মোটা হয়ে যাওয়ার ধরুন কীটনাশক এসব কীটের শরীরে ঢুকতেই পারে না।
আবার কোনও কোনও প্রজাতির ছারপোকা আবার কীটনাশক হজম করে ফেলার শক্তিও অর্জন করেছে। আমেরিকা ইউনিভার্সিটি অব কেন্টাকির পতঙ্গ বিশারদ ও গবেষক সুবা পালি এর মতে উপদ্রুত জায়গায় ৩০ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপ দিয়ে ছারপোকা মারাটাই সবচেয়ে কার্যকর উপায়। এ ছাড়া বাড়ির আসবাবগুলি রোদে দিয়েও ছারপোকা মারা যায়। কারণ, রোদের হাত থেকে বাঁচার উপায় এখনো ‘আবিষ্কার’ করতে পারেনি ছারপোকারা !
তবে প্রচলিত বেশ কিছু উপায়ে আমরা ছারপোকার আক্রমণ থেকে মুক্তি পেতে পারি।
ঘর, আসবাব পত্র পরিষ্কার রাখা
ছারপোকা সাধারণত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাসা বাধে । তাই সপ্তাহে একবার হলেও সারা ঘর ভালো করে পরিষ্কার করা উচিত । এতে করে ছারপোকার বসবাসে বাধা আসবে। ছারপোকা মোটামুটি ১১৩ ডিগ্রি তাপমাত্রাতে মারা যায় বলে ঘরে ছারপোকার বিস্তার হলে বিছানার চাদর, বালিশের কভার, কাঁথা ও ঘরের ছারপোকা আক্রান্ত জায়গাগুলোর কাপড় বেশি তাপে সিদ্ধ করে ধুয়ে ফেলুন। ছারপোকা এতে মারা যাবে। আর নিয়মিত আসবাব পত্র পরিষ্কার রাখলে ছারপোকার বসবাস কমে আসে।
কেরোসিনের প্রলেপ
কেরোসিনের নানা বিধ ব্যবহার রয়েছে। ছারপোকা তাড়াতে মাঝে মাঝে আসবাবপত্রে কেরোসিনের প্রলেপ দিতে পারেন এতে ছারপোকা সহজেই কেরোসিনের গন্ধে পালিয়ে যায়।
ন্যাপথালিন
উদ্বায়ী ন্যাপথালিন আরশোলা তারানো সহ নানা কাজে ব্যবহার করি। আজ থেকে আপনি একে ছারপোকা তাড়ানোর কাজেও ব্যবহার করতে পারবেন । ছারপোকা তাড়াতে ন্যাপথলিন খুবই কার্যকর । ছারপোকার উপদ্রব থেকে মুক্তি পেতে মাসে অন্তত দু’বার ন্যাপথলিন গুঁড়ো করে বিছানাসহ উপদ্রবপ্রবণ স্থানে ছিটিয়ে দিয়ে রাখুন।
ল্যাভেন্ডার অয়েল স্প্রে করুন
ঘরের যে স্থানে ছারপোকার থাকে বলে ধারনা করছেন সেখানে ল্যাভেন্ডার অয়েল স্প্রে করুন। দুই থেকে তিন দিন এভাবে স্প্রে করলে ছারপোকা আপনার ঘর ছেড়ে পালাবে।
এরোসল স্প্রে
অনেকে বলে থাকেন এরোসল স্প্রে করে নাকি ছারপোকা থেকে মুক্তি পেয়েছেন। দরজা জানালা বন্ধ করে এরোসল দিয়ে দীর্ঘ সময়ের জন্যে রুম বন্ধ করে রাখুন। আবার রুমের প্রবেশ করে সাথে সাথে দরজা জানাল খুলে দিয়ে এরোসলের বিষাক্ত ভাব দূরে করে নিন।
অ্যালকোহল স্প্রে
অ্যালকোহল মানেই কিন্ত অ্যালকোহল না। 😛 একে ভাল কাজেও ব্যবহার করা যেতে পারে । এই যেমন আপনার ঘরের ছারপোকা তাড়াতে অ্যালকোহল ব্যবহার করতে পারেন। ছারপোকা যুক্ত স্থানে সামান্য অ্যালকোহল স্প্রে করে দিন দেখেবেন ছারপোকা মরে যাবে।
কীটনাশক ব্যবহার
আপনি চাইলে কীটনাশকও ব্যবহার করতে পারেন। কীটনাশক মানেই বিষাক্ত কিছু । তাই ব্যবহারের পূর্বে যথা সম্ভব সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। ব্যবহারের পূর্বে অবশ্যই অবশ্যই প্যাকেটের গায়ে লেখা সর্তকতা সমূহ ভালভাবে পড়ুন এবং মেনে চলুন। বাসার বাচ্চাদের কীটনাশকের আশেপাশে আসতে দিবেন না। নিজের শরীর ভালভাবে ঢেকে নিবেন। আবার ব্যবহার শেষে কীটনাশকের বোতলকে নির্ধারিত স্থানে ফেলুন বা মাটিতে পুতেঁ ফেলুন।
ছারপোকা থেকে বাচার সবচেয়ে কার্যকরী ওষুধ হলো aluminium phosphide। এই কীটনাশকটি আপনি যেকোনো সার ও বীজের দোকানে পাবেন একটি বোতলে ত্রিশটি ট্যাবলেট থাকে। যে রুমে ছারপোকার উপদ্রব হয়েছে,সেই রুমের সমস্ত দরজা জানালা বন্ধ করে রুমের মাঝখানে একটা পেপারের উপরে ১৫/২০ টা ট্যাবলেট রেখে রুম বন্ধ করে দিতে হবে।১/২ দিন ওই রুমে যাওয়া যাবে না।কারন ওষুধ গুলো থেকে বিষাক্ত গ্যাস বের হয়ে পুরো রুমে ছড়িয়ে পড়বে।এই গ্যাস অত্যন্ত ক্ষতিকর এমনকি মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে। এই ওষুধ দেবার পর বাসার বাইরে অন্য কোথাও থেকে ২/১ বেড়িয়ে আসতে হবে।তারপর বাসায় ফিরে প্রথমে ঘরের জানালা দরজা সব কিছু সময়ের জন্য খুলে রাখতে হবে।ট্যাবলেট গুলো সব ছাই হয়ে কাগজের উপর পড়ে থাকবে,সেগুলোকে সতর্কতার সাথে বাইরে ফেলে দিতে হবে।
ছারপোকা কামড়ালে কি করবেন
ছারপোকা কামড়ালে যখন প্রথম দেখবেন তখনই জীবাণুনাশক সাবান ও পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এর পরে নীচের প্রাকৃতিক জিনিসগুলো ব্যবহার করতে পাএন।
কলার খোসা
কলার খোসাতে ‘ক্যারোটেনয়েডস’, ‘পলিফেনলস’ ইত্যাদি জৈব-সক্রিয় ভেষজ উপাদান থাকে । কলার খোসার ভেতরের অংশে থাকা এই উপাদানগুলো কামড়ানো স্থানে ঘষলে জ্বালাপোড়া কিংবা চুলকানির অনভূতি প্রশমিত হবে।
লবণ
লবণ একটি প্রাকৃতিক ব্যাক্টেরিয়ানাশক । লবণ ছারপোকার কামড় থেকে হওয়া র্যাশ ও প্রদাহ সারাতে সাহায্য করে। কামড়ানোর জায়গায় লবণ ঘষলে ব্যথা ও জ্বালাপোড়া থেকে দ্রুত উপশম পাওয়া যায়।
মাউথ ওয়াস
মাউথ ওয়াসকে ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে থাকে ‘ইথানল’, যা একটি জীবানুনাশক উপাদান এবং অ্যালকোহল। তুলার নিয়ে তা মাউথওয়াশে ডুবিয়ে কামড়ানো অংশে প্রয়োগ করুন । জ্বালা ভাব কমবে।
বেকিং সোডা ও পানির প্রলেপ
বেকিং সোডা ও পানির প্রলেপ বানান । একটু ঘন করে বানাবেন । কামড়ানো স্থানে এই পেস্ট দিয়ে রাখুন । দেখবেন জ্বালাপোড়া কমবে। শুকিয়ে গেলে ধুয়ে ফেলুন।
কমলার রস
একটি তুলা টুকরা নিয়ে এটি কমলার রস দিয়ে ভিজিয়ে আক্রান্ত স্থানে কিছু সময় দিয়ে রাখুন। জ্বালা ভাব দূর হবে।
দারুচিনি ও মধু
দারু চিনি ও মধু এই দুটি উপাদান একত্রে মিশিয়ে ছারপোকার কামড়ের চিকিৎসায় কাজে ব্যবহার করতে পারেন। দুই তিন টেবিল-চামচ দারুচিনির গুঁড়ার সঙ্গে কয়েক ফোঁটা মধু মিশিয়ে আক্রান্ত স্থানে মাখতে রাখুন এর পরে শুকিয়ে গেলে ধুয়ে ফেলুন। প্রতিদিন তিন থেকে চারবার পেস্টটি প্রয়োগ করা যেতে পারে।
টুথপেস্ট
আগুনের জ্বালা পোড়া থেকে উপশম পেতে আমরা যেমন টুথপেস্ট ব্যবহার করি তেমন ছারপোকার কামড় যুক্ত স্থানে আমরা টুথপেস্টে প্রলেপ দিত পারি । কামড়ানো অংশে ১০ মিনিট টুথপেস্টের প্রলেপ দিয়ে এর পর ধুয়ে ফেলতে হবে। এতে থাকা মেনথল কামড়ানো অংশে ঠাণ্ডা অনুভূতি দেয়, যা চুলকানি ও জ্বালাপোড়া কমায়। এটিও প্রতিদিন বেশকয়েকবার ব্যবহার করতে পারেন।
ডাক্তারে সাথে যোগাযোগ
ঘরুয়া পদ্ধতিতে ব্যাথা বা জ্বালা ভাব দূর না হলে দ্রুত ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় মেডিকেশন নিন।
ছারপোকা একটি বিরক্তির কীট। এটি কামড়ে খুব জ্বালা পোড়া করে । শুধু যিনি আক্রান্ত হয়েছেন ইনি এর যন্ত্রণার কথা ভাল বলতে পারবেন। তাই বাসা বাড়িতে ছারপোকা দৃষ্টিগোচর হওয়া মাত্র এটি নির্মুলে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।