দ্রাবিড় দ্যা ওয়াল
রাহুল দ্রাবিড়–ক্রিকেট এর দুনিয়াতে খুবই পরিচিত এক নাম; এক কিংবদন্তী। তাঁর ১৬ বছরের ক্যারিয়ারে তিনি বহু ওয়ার্ল্ড রেকর্ড করেছেন। এই কিংবদন্তী ভারতের মধ্যপ্রদেশে ১৯৭৩ সালের ১১–ই জানুয়ারী জন্মগ্রহন করেন। তাঁর ডিফেন্সিভ ব্যাটিং এর ভঙ্গি এবং উইকেট আঁকড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বোলারদের ঘাম ঝরিয়ে শক্ত দেয়ালের মত টিকে থাকার মুগ্ধকর সামর্থ্যের জন্য তিনি “দ্যা ওয়াল” নামেও পরিচিত। তিনি ২০০৪ সালে আইসিসি দ্বারা বছরের সেরা ক্রিকেটার নির্বাচিত হন। উইজডেন তাঁকে সর্বকালের তৃতীয় সর্বশ্রেষ্ঠ টেস্ট ব্যাটসম্যান হিসেবে চিহ্নিত করে। টেস্ট ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি ক্যাচ(নন–উইকেটকিপার হিসেবে)ধরার রেকর্ডটি তাঁরই দখলে–২১০টি। তিনিই সর্বপ্রথম ও একমাত্র ক্রিকেটার যিনি টেস্ট খেলুড়ে দশটি দেশেই সেঞ্চুরি করেছেন।
এক নজরে রাহুল দ্রাবিড়
পুরো নাম – রাহুল শারদ দ্রাবিড়
জন্ম – ১৯৭৩ সালের ১১–ই জানুয়ারী, ভারতের মধ্যপ্রদেশে
ডাকনাম – জ্যামি, দ্যা ওয়াল, মি.ডিপেন্ডেবল
উচ্চতা – ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি (১.৮০ মিটার)
ব্যাটিং স্টাইল – ডানহাতি ব্যাটসম্যান
বোলিং স্টাইল – ডানহাতি অফ স্পিন
ভূমিকা – ব্যাটসম্যান, উইকেটকিপার(যখন প্রয়োজন)
জীবনের প্রথম ধাপ ও ক্রিকেট কারিয়ারের শুরু
এই বিস্ময়কর ক্রিকেটার ভারতের মধ্যপ্রদেশে জন্ম নিলেও পরে তাঁর পরিবারের সাথে তিনি ব্যাঙ্গালোরের কর্ণাটকে চলে যান। সেখানেই তিনি বেড়ে উঠেন। দ্রাবিড় এর পিতা জ্যাম বানানোর এক কোম্পানিতে কাজ করতেন; এ সূত্রেই পরে তাঁর ডাকনাম “জ্যামি”–এর উদ্ভব হয়। তাঁর মাতা পুষ্পা কর্ণটকের এক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের আর্কিটেকচার বিষয়ের প্রোফেসর ছিলেন। তাঁর বিজয় নামে এক ছোট ভাই ছিল। দ্রাবিড় ব্যাঙ্গালোরের “সেন্ট জোসেফ’স বয়জ হাই স্কুল”–এ স্কুল জীবন অতিবাহিত করেন। পরে তিনি ব্যাঙ্গালোরের “সেন্ট জোসেফ’স কলেজ অফ কমার্স”–এ অধ্যয়ন করে কমার্সে ডিগ্রি লাভ করেন।
দ্রাবিড় ১২ বছর বয়সে ক্রিকেট খেলা শুরু করেন। তিনি কর্ণাটকের হয়ে অনূর্ধ্ব–১৫, অনূর্ধ্ব–১৭ ও অনূর্ধ্ব–১৯ লেভেলে খেলেন। ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে রঞ্জি ট্রফিতে তাঁর অভিষেক হয়; তখন তিনি কলেজে পড়তেন। সেই ম্যাচে তিনি ৮২ রান করেন। তাঁর প্রথম খেলা পুর্ণ মৌসুম ছিল ১৯৯১–৯২ যেখানে তিনি ২টি সেঞ্চুরি করেন ও মোট ৩৮০ রান(৬৩.৩ গড়ে) করে মৌসুম শেষ করেন।
*ফার্স্ট ক্লাস ক্যারিয়ার
ব্যাটিং >> ম্যাচ–২৯৮, রান–২৩৭৯৪, গড়–৫৫.৩৩, সেঞ্চুরি–৬৮,
হাফ সেঞ্চুরি–১১৭, সর্বোচ্চ রান–২৭০
বোলিং >> মাচ–২৯৮, বল–৬১৭, উইকেট–৫, সেরা বোলিং ফিগার–২/১৬
ফিল্ডিং >> ৩৫৩টি ক্যাচ
*তাঁর ঘরোয়া দলসমূহের তথ্য
১৯৯০–২০১২ >> কর্ণাটক
২০০০ >> কেন্ট
২০০৩ >> স্কটল্যান্ড
২০০৮–২০১০ >> রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর
২০১১–২০১৩ >> রাজাস্থান রয়্যালস
আন্তর্জাতিক অভিষেক
ওয়ানডে
১৯৯৬ সালের ৩ এপ্রিল শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে ম্যাচে(সিঙ্গার কাপ) তাঁর আন্তর্জাতিক অভিষেক হয়। সেই ম্যাচে তিনি ব্যাট হাতে সফল হতে পারেননি; মাত্র তিন রানে মুত্তিয়া মুরালিধারান এর বলে আউট হয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরেন তিনি। সেই সিরিজের পরের ম্যাচেও তিনি ব্যাট হাতে ব্যার্থ, করেন ৪ রান; প্রতিপক্ষ ছিল পাকিস্তান।
টেস্ট
ওয়ানডে অভিষেক সুখকর না হলেও সেই তুলনায় তাঁর টেস্ট অভিষেক সাফল্যের সাথেই হয়। ১৯৯৬ সালের ২০শে জুন ক্রিকেটের মক্কা লর্ডসে ইংল্যান্ড এর বিপক্ষে তিন ম্যাচ সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে তাঁর টেস্ট অভিষেক হয়। সেই ম্যাচে ৭ নম্বরে ব্যাট করতে নেমে তিনি আরেক অভিষিক্ত ব্যাটসম্যান সৌরভ গাঙ্গুলির(সেই ম্যাচে তাঁরও অভিষেক হয়) সাথে মূল্যবান এক পার্টনারশিপ করেন ও দলকে লিড এনে দেন। ৬ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে ব্যাটিং করে তিনি ৯৫ রান করে আউট হলে ৫ রানের জন্য অভিষেকে সেঞ্চুরির সৌভাগ্য হাতছাড়া হয়।
**আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার (পরিসংখ্যানে)
১৬৪টি টেস্ট ম্যাচ >> ব্যাটিং-> রান–১৩২৮৮, গড়–৫২.৩১, সেঞ্চুরি–৩৬
হাফ সেঞ্চুরি–৬৩, সর্বোচ্চ–২৭০
ফিল্ডিং-> ২১০টি ক্যাচ
৩৪৪টি ওয়ানডে ম্যাচ >> ব্যাটিং-> রান–১০৮৮৯, গড়–৩৯.১৬, সেঞ্চুরি–১২
হাফ সেঞ্চুরি–৮৩, সর্বোচ্চ–১৫৩
ফিল্ডিং-> ১৯৬টি ক্যাচ, ১৪টি স্ট্যাম্পিং
১টি টি–২০ ম্যাচ >> ব্যাটিং-> রান–৩১
এছাড়াও তিনি হলেন টেস্ট ক্রিকেটে তৃতীয় সর্বোচ্চ রানকারী ব্যাটসম্যান। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বল খেলা ও সবচেয়ে বেশি সময় খেলার(ব্যাটিং এর সময়) রেকর্ডটি তাঁর। তিনি তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ারে মোট ৩১,২৫৮টি বল খেলেছেন–যা কিনা ওয়ার্ল্ড রেকর্ড,এমনকি অন্য কোনো ব্যাটসম্যানই ৩০০০০ বলও খেলেনি। তিনি ব্যাটিং এর সময় ক্রিজের অপর প্রান্তে দাড়িয়ে থেকে মোট ৪৫৩টি উইকেট পরতে দেখেছেন–যা কিনা কোনো ব্যাটসম্যানের টেস্ট ক্যারিয়ারে সর্বোচ্চ। সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরির পার্টনারশিপ ও সবচেয়ে বেশি হাফ সেঞ্চুরির পার্টনারশিপ এর রেকর্ডও তাঁর দখলে–যথাক্রমে ৮৮টি ও ১২৬টি; আরেকটি ওয়ার্ল্ড রেকর্ড। তাঁর ১৬ বছরের ক্যারিয়ারে এমনি অসংখ্য ওয়ার্ল্ড রেকর্ড গড়েছেন মি.ডিপেন্ডেবল।
ব্যাক্তিগত জীবন
২০০৩ সালের ৪ মে তিনি বিজেতা পেনধারকার নামের ভারতের নাগপুরের এক সার্জনকে বিয়ে করেন। ২০০৫ সালে প্রথম সন্তান হয় তাদের, যার নাম রাখা হয় সমিত। পরে ২০০৯ সালে তাঁর আরেকটি পুত্র সন্তান হয়, নাম রাখা হয় অভয়।
অবসর গ্রহণ
দ্রাবিড় তাঁর এই দীর্ঘ ১৬ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ইতি টানেন ২০১২ সালের ২৪শে জানুয়ারী, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচ খেলে। এর প্রায় তিন মাস আগেই তিনি ওয়ানডে ম্যাচ থেকে অবসর নেন। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ইতি টানার পরেও তিনি ঘরোয়া পর্যায়ে(IPL ও CL-T20) খেলে গেছেন। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর–অক্টোবরে অনুষ্ঠেয় চ্যাম্পিয়ন্স লীগ টি–২০ এ তাঁর নেতৃত্বে রাজাস্থান রয়্যালস রানার্স–আপ হয়। ২০১৩ সালের ৬ অক্টোবর চ্যাম্পিয়ন্স লীগ টি–২০ এর ফাইনাল ম্যাচটি খেলে তিনি তাঁর পুরো বর্ণাঢ্য ক্রিকেট ক্যারিয়ারের সমাপ্তি ঘটান।
দ্রাবিড় ছিলেন একজন আইকন, ক্রিকেট খেলার সত্যিকারের এক বাহক। দলের প্রয়োজনে তিনি তাঁর রঙ বদলেছেন; কখনো করেছেন উইকেট কিপিং; ৩ নম্বর পজিশনে ব্যাটিং করলেও দলের প্রয়োজনে কখনো ব্যাট হাতে ম্যাচ ওপেন করতে নেমে পরেছেন,এমনকি তিনি দলের প্রয়োজনে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাটিং লাইন–আপ এর সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন,ব্যাট করেছেন ৮ নম্বরেও। তাঁর ক্রিকেট ক্যারিয়ারের ইতি ঘটলেও ক্রিকেটের প্রতি তাঁর অবদান কখনোই পূরণ করার মত নয়। খুবই কম ক্রিকেটার তাঁর মত ধৈর্য, সততা ও নিষ্ঠার সাথে বছরের পর বছর খেলেছেন। রাহুল দ্রাবিড়–আসলেই এক কিংবদন্তী