৪১ দিনের চুক্তির ফারাক্কা বাঁধ বাংলাদেশের জন্যে এক মরণ ফাঁদ !
গত কয়েক দশক ধরে ফারাক্কা একটি আলোচিত ইস্যু। ফারাক্কা বাঁধ গঙ্গা নদী উপর দেওয়া একটি বাঁধ। এই বাঁধটি ভারতের পশ্চিম বঙ্গের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলায় অবস্থিত। কলকাতা বন্দরের নাব্যতা বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় রাজমহল ও ভগবানগোলার মাঝে ফারাক্কা নামক স্থানে বাঁধটি নির্মাণ করে। ফারাক্কা বাঁধ ২২৪৫ মিটার বা প্রায় ৭৩৬৫ ফুট লম্বা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার পশ্চিম সীমানা থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার (১১ মাইল) উজানে গঙ্গা নদীর ওপর বাঁধটির অবস্থান।
ফারাক্কা বাঁধের ইতিহাস
পলি জমা হবার কারণে ব্রিটিশ কতৃপক্ষ দেখল কলকাতা বন্দরে জাহাজ ভিড়ানোর অসুবিধা হচ্ছে। কারন হিসেবে তারা দেখল হুগলী-ভাগরথী নদী ক্রমশঃ নাব্যতা হারাচ্ছে। এ উদ্দেশ্য ব্রিটিশ সরকার ১৮৫১ সাল থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত কমপক্ষে পাঁচটি সমীক্ষা করেন যে কিভাবে গঙ্গার পানির এক অংশ ঘুরিয়ে হুগলী-ভাগরথীতে প্রবাহিত করে পলি অপসারণ করা যায়।
ভারত ভাগের পরে ৫০ ও ৬০ দশকে ভারত দেখল পলির সঞ্চয় কলকাতা বন্দরের জন্যে একটি একটি বিশাল সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। তখন তারা ফারাক্কা বাঁধ নির্মানের সিদ্ধান্ত নেয়। তৎকালীন বিভিন্ন সমীক্ষায় বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করেন যে গঙ্গা/পদ্মার মত বিশাল নদীর গতি বাঁধ দিয়ে বাঁধা প্রদান করলে নদীর উজান এবং ভাটি উভয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য মারাত্মকভাবে নষ্ট হতে পারে। এ ধরণের নেতিবাচক কারন থাকা সত্ত্বেও ভারত সরকার ফারাক্কায় গঙ্গার উপর বাঁধ নির্মাণ ও হুগলী-ভাগরথীতে সংযোগ দেয়ার জন্য ফিডার খাল খননের পরিকল্পনােও কাজ শুরু করে । এই ফিডার খালের দৈর্ঘ্য ২৫ মাইল বা প্রায় ৪০ কিলোমিটার।
ফারাক্কা নিয়ে বিতর্কে শুরু সেই পাকিস্থান আমল থেকেই। এই বাঁধের বিষয়টি প্রথম আলোচনায় আসে ২৯ অক্টোবর, ১৯৫১ সালে। পাকিস্তান সরকার গ্রীষ্মকালে গঙ্গা নদী হতে বিপুল পরিমাণ পানি পশ্চিমবঙ্গের ভাগীরথী নদী পুনরুজ্জীবিত করার জন্য অপসারণ করার ভারতীয় পরিকল্পনার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তখন ভারত সরকার জবাব দেয় তাদের এই পরিকল্পনা একদম প্রাথমিক পর্যায়ে আছে এবং এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে পাকিস্তানের উদ্বেগ সম্পূর্ণ অনুমান নির্ভর। সেই থেকে গঙ্গার পানি বন্টন নিয়ে আলাপ-আলোচনার সৃষ্টি হয়। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান ও ভারত সরকার বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে সরকার প্রধান পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে গঙ্গার প্রবাহ বণ্টনের ব্যাপারে বহুবার আলোচনায় বসেছে।আলোচনা চলমান থাকলেও ভারত সরকার ফারাক্কা বাঁধের নির্মান কাজ চালিয়ে যায়।
ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ
১৯৬১ সালে বাঁধের মূল নির্মাণকাজ হাতে নেওয়া হয় যা ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসে শেষ হয়। ফারাক্কা বাঁধ ২,২৪০ মিটার (৭,৩৫০ ফু) লম্বা যেটা প্রায় এক বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে সোভিয়েত রাশিয়ার সহায়তায় বানানো হয়েছিল। পানি প্রবাহের জন্যে ৪০,০০০ কিউসেক গেটের সংখ্যা ১০৯টি। প্রতি গেটের প্রবাহ সমতা ৭০৯ কিউসেক। হুগলী ভাগীরথীর প্রবেশ স্থান বাঁধের দৈর্ঘ্য ২২৪ মিটার। ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল থেকে বাঁধ চালু হয়। ১৯৭৫ সালে ২১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ৪১ দিনের জন্য পরীামূলকভাবে ফারাক্কা বাঁধের সব ফিডার ক্যানেল চালুর কথা বলে ভারত। কিন্তু ওই ৪১ দিনের পরিবর্তে ৪১ বছর পরও বাঁধটি চালু আছে।
ফারাক্কা চুক্তি ও বাংলাদেশের সাথে আলোচনার দীর্ঘ সারি
ভারতের সাথে বাংলাদেশের প্রথম পানিবিরোধ শুরু হয় ফারাক্কা বাঁধ বা ফারাক্কা ব্যারাজ নিয়ে। এই বাঁধের উদ্দেশ্য হল , ভাগীরথী নদী দিয়ে ৪০,০০০ কিউসেক পানি প্রত্যাহারের মাধ্যমে কলকাতা বন্দরকে সচল রাখা। ভারত ফারাক্কার মাধ্যমে এক তরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি, কৃষি, লবণাক্ততা, নৌপরিবহণ, মৎস সম্পদ ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। ভারত সরকার মূলত শুকনা মৌসুমে ফারাক্কার উজানে পানি প্রত্যাহার করে। ফলে ফারাক্কার ভাটিতে বাংলাদেশ অংশে গঙ্গা নদীতে পানি প্রবাহ হ্রাস পায় এবং ভূগর্ভস্থ পানি সমতল মাত্রা নিচে নেমে যায়। পরিণতিতে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যায়। এর ফলে নদীর ধারণ ক্ষমতা হ্রাস পায়। বর্ষা মৌসুমে বাঁধের নিয়ন্ত্রক গেট খুলে দেয়া হয়। সে সময়ে তীব্র বেগে ধেয়ে আসা পানি বাংলাদেশে বন্যা ঘটায়।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর গঙ্গার জল বন্টন নিয়ে ভারতের সাথে আলোচনা শুরু করে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালে ভারত ও বাংলাদেশের পানি বিশেষজ্ঞ নিয়ে যৌথ নদী কমিশন গঠন করা হয় , এই কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শুকনা মৌসুমে ভারতের অংশে ফারাক্কা ব্যারাজের ভাটিতে এবং বাংলাদেশ অংশে হার্ডিঞ্জ ব্রীজের ভাটিতে যৌথভাবে পানি প্রবাহ এবং সংশ্লিষ্ট তথ্যাদি সংগ্রহ করা হয়। তথ্য সংগ্রহ ও বিনিময়ের পরেও বাংলাদেশ তার পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে।
১৯৭৪ সালের ১৬ মে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ফারাক্কা পয়েন্টে গঙ্গার পানি বণ্টন বিষয়ে এক যৌথ বিবৃতি দেন। এই যৌথ বিবৃতিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় , উভয় দেশ একটি চুক্তিতে আসার আগে ভারত ফারাক্কা বাঁধ চালু করবে না। ১৮ এপ্রিল,১৯৭৫ এক যৌথ সংবাদ বিজ্ঞপ্তি আকারে ৪১ দিন মেয়াদের অন্তবর্তীকালীন চুক্তির ঘোষণা দেওয়া হয়।চুক্তি অনুযায়ী ভারত ২১-৩০ এপ্রিল ১১০০০ কিউসিক, ১-১০ মে ১২০০০ কিউসিক, ১১-২০ মে ১৫০০০ কিউসিক, ২১-৩১ মে ১৬০০০ কিউসিক পানি প্রত্যাহার করবে।বাংলাদেশ ও ভারত গঙ্গার পানির হিস্যা ও প্রবাহ বৃদ্ধি নিয়ে মূল বিরোধ এড়িয়ে ফারাক্কা বাঁধ চালুর জন্য অস্থায়ী সমঝোতায় উপনীত হয়।
এই যুক্তি অনুসারে অনুসারে বাংলাদেশ অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য শুকনা মৌসুমে ফারাক্কা পয়েন্টে (ব্যারাজের ভাটিতে) ৪৪,০০০ কিউসেক পানি (১ কিউসেক = প্রতি সেকেন্ডে প্রবহমান এক ঘনফুট পানি) পাবে। ১৯৭৫ সালের ৩১ মে তারিখে এই চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। এখনো আজও বাংলাদেশ পানির ন্যায্য হিস্যা বুঝে পায় নি।
এর পরে আসে জিয়াউর রহমানের শাসন । জিয়াউর রহমান ভারতের সাথে অন্য সমস্যাগুলোর সাথে সাথে “ফারাক্কা বাঁধ” সমস্যা উত্তরাধিকার সূত্রে পান ।এই সমস্যা সমাধানের জন্য ১৮ ডিসেম্বর,১৯৭৫ রাষ্ট্রপতি ও প্রধান আইন প্রশাসক বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় দু’টি সিদ্ধান্ত গ্রহীত হয়।
প্রথমত, একতরফা পানি প্রত্যাহারের বিরুদ্ধে ভারতের কাছে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানানো
দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত ছিলো অধিক গুরুত্বপূর্ণ “to suggest a joint study for the entire dry season of 1976 with the quantum of withdrawals as agreed in April,1975.” (B.M.Abbas ‘Ganges water dispute’ p-46) ১৯৭৫ সালের এপ্রিলের যুক্তি অনুযায়ী ১৯৭৬ সালের শুষ্ক মৌসমে পানি পানি প্রত্যাহারের পরিমান যৌথভাবে হিসাব করা।
এই উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকার ১৫ জানুয়ারি,১৯৭৬ বাংলাদেশ ভারতের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবাদ জানায়। প্রতিবাদ লিপিতে অস্থায়ী চুক্তির ৪০ দিনের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরও ভারতের পানি প্রত্যাহারকে “breach of the agreement” বা যুক্তির লঙ্ঘন বলে জানানো হয়।
৩ ফেব্রুয়ারি,১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ সরকার আবারও প্রতিবাদ লিপি পাঠায়। এতে গঙ্গার স্বাভাবিক প্রবাহ বিঘ্ন সৃষ্টিকারী যে কোন প্রচেষ্টা থেকে ভারতকে বিরত থাকতে বলা হয় !
এর মধ্যে ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারীতে মাওলানা ভাসানী ইন্ডিয়ার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে লেখা এক চিঠিতে বলেন ,
“বিশ্বের অন্যতম মহাপুরুষ মহাত্না গান্ধীকে তোমার দেশের বিশ্বাসঘাতক নাথুরাম গডসে হত্যা করে যে মহাপাপ করেছে তার চেয়েও জঘন্য পাপ তোমরা করছ”।
উক্ত চিঠির জবাবে মিসেস গান্ধী ভাসানীকে জানান যে,
প্রতিবেশীদের মধ্যে সমস্যা দেখা দেওয়া স্বাভাবিক। তবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো সমঝোতা ও সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে সমাধান অন্বেষণ করতে হবে। মোকাবিলা ও বৈরিতার পথ অনুসরণ করে আমরা পরস্পরের ক্ষতি করতে পারি মাত্র। (দৈনিক ইত্তেফাক ৯.৫.১৯৭৬)
মাওলানা ভাসানী ১৬ মে,১৯৭৬ ফারাক্কা অভিমূখে লং মার্চ কর্মসূচী ঘোষণা করেন। ভাসানীর নেতৃত্বে শান্তিপূর্ণ বিশাল গণ মিছিল ফারাক্কা অভিমুখে যাত্রা করে । পরদিন ১৭ মে মিছিল শেষ হয়েছিল কানসাটে গিয়ে, বাংলাদেশের সীমানার ভেতরে। তার এ ডাকে সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দেন। ঐ সময় মহনন্দা নদীর উপর কোনো সেতু ছিলনা, স্থানীয়রা নৌকা দিয়ে সেতু বানিয়ে মিছিল নিয়ে কানসাট অভিমুখে রওয়ানা হয়। প্রচণ্ড খরাকে উপেক্ষা করে ফারাক্কা বাঁধ তৈরির প্রতিবাদে মানুষ ফুঁসে উঠে। রাস্তার আশপাশের মানুষ ওই মিছিলের লোকজনকে পানি, খাবারসহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে। এই মিছিলের আতংকে ভারত সরকার রীতিমতো যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছিল বলে জানা যায় । এ প্রসঙ্গে মওলানা ভাসানী তাঁর ভাষণে বলেছিলেন,
“বাংলাদেশের দরিদ্র নিরস্ত্র মানুষের ভয়ে ভারতকে যখন সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করতে হয়েছে তখন তার অবিলম্বে ফারাক্কা সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসা উচিত। ”
“ফারাক্কা প্রত্যাহার করে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা ভাটির দেশে নিশ্চিত না করলে আন্তর্জাতিক আদালতে যাব।”
এরপর বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোরারজী দেশাই গঙ্গার পানি বন্টন বিষয়ে ১৯৭৭ সালের ৫ নভেম্বর ৫ বছর মেয়াদি এক চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ শুকনা মৌসুমে ফারাক্কা পয়েন্টে ৩৪, ৫০০ কিউসেক পানি পাবে। ১৯৮২ সালের ৪ নভেম্বর তারিখে এই চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়।
তারপর রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে ১৯৮২ ও ১৯৮৫ সালে ভারতের সাথে আরো দুটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছিল।
ফারাক্কা পয়েন্টে ১ জানুয়ারি হতে ৩১ মে সময়কালে ১০ দিন অন্তর হিসেবে ভারত ও বাংলাদেশ কে কী পরিমাণ পানি পাবে এই ভাগ বাটোয়ারার বিষয়ে ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর তারিখে ভারত সরকার ও বাংলাদেশ সরকারের মাঝে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গা পানি চুক্তি সম্পাদিত হয়। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারত সরকারের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবগৌড়া ত্রিশ বছর মেয়াদী এই চুক্তি স্বাক্ষর করেন ।
ফারাক্কা চুক্তি অনুসারে
ফারাক্কা পয়েন্টে পানি প্রবাহ ৭০,০০০ কিউসেক হলে ভারত ৫০% এবং বাংলাদেশ ৫০% পাবে। পানিপ্রবাহ ৭০,০০০ হতে ৭৫,০০০ কিউসেক হলে বাংলাদেশ পাবে ৩৫,০০০ কিউসেক এবং অবশিষ্ট পাবে ভারত। পানিপ্রবাহ ৭৫,০০০ কিউসেক এর বেশি হলে ভারত ৪০,০০০ কিউসেক এবং অবশিষ্ট বাংলাদেশ। এই চুক্তিটি বর্তমানে কার্যকরী আছে। ফারাক্কা পয়েন্টে গঙ্গা নদীর পানি চুক্তি ভারত ও বাংলাদেশের মাঝে প্রথম এবং একমাত্র পানি চুক্তি। উৎস: Ganges Water Treaty,1996, AppendixA)।,
ফারাক্কা বাঁধের প্রভাব
বাংলাদেশের ও আন্তর্জাতিক চাপে ভারত বাংলাদেশের সাথে একটি পানি চুক্তি করলেও ভারত কোনোদিনই সেই চুক্তি মোতাবেক বাংলাদেশকে পানি দেয়নি। শুষ্ক মৌসুমে ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে গঙ্গার/পদ্মার পানি অপসারণের ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে । পদ্মা এবং তার শাখা প্রশাখা ১৯৬০ সালের তুলনায় নাব্যতা হারিয়েছে প্রায় ৭০%। বহু ছোট নদী শুকিয়ে গেছে কিম্বা মৃতপ্রায়। এককালের প্রমত্তা মধুমতি-গড়াই শীতের সময় ক্ষীণ ধারা। এর প্রভাব বাংলাদেশে কৃষি, শিল্প, মৎস্য, বনজ, নৌপরিবহন সহ আরো নানা ক্ষেত্রে পড়েছে। ফারাক্কার প্রভাবে বাংলাদেশকে ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে। জানা যায় শুধু প্রত্যক্ষ ভাবেই বাংলাদেশের প্রায় ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার ক্ষতি সম্মুক্ষিন হয়। আবার যদি পরোক্ষ হিসাব ধরা হয় , তাহলে ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি হবে।
প্রফেসর এম, আই চৌধুরী এবংসৈয়দ সফিউল্লাহ জাতিসংঘ পরিবেশ অধিদপ্তর ও হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ‘গ্লোবাল কার্বন প্রবাহ’ গবেষণা প্রকল্পে বিভিন্ন গুরত্বপুরন তথ্য উঠে আসে । ৮ বছরের সমীক্ষার ফলাফল সংক্ষেপে নিম্নোরূপ :
-
পদ্মা নদী দিয়ে আসা পলিপ্রবাহ প্রায় ২০% কমে গেছে (১৯৬০ সালের তুলনায়)।
-
কার্বন প্রবাহ কমেছে ৩০%।
-
পলির প্রাবাহ কম থাকায়, পলিপ্রবাহ কম আসার কারণে জমির উর্বরা শক্তি নষ্ট হচ্ছে।
-
মিনারেল এবং নিউট্রিয়েন্ট কমে যাওয়ার ফলে নদী ও জলাভূমিতে ফাইটোপ্লাকটন উৎপাদন কমেছে ৩০%।উল্লেখ্য ফাইটোপ্লাকটন হল খাদ্য চক্রের প্রথম ধাপ। এটি মাছ ও অন্যান্য জলজ জীবের প্রধান খাদ্য । পদ্মা-ব্রক্ষপুত্রের মিলনস্থল আরিচাঘাটের সমীক্ষা থেকে যে ফিশ ক্যালেন্ডার তৈরী করা হয়েছে সেটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ৩৫ বছর আগের তুলনায় বর্তমান মাছ উৎপাদন মাত্র ২৫%। ইলিশ মাছ এখানে পাওয়া যায় না বল্লেই চলে। ফারাক্কা বাঁধ দেওয়ার আগে এক সময় রাজশাহীর পদ্মা অবধি ইলিশ মাছ পাওয়া যেত। এখন আরিচাতেই এ মাছ পাওয়া যায় না। ফারাক্কা বিদ্যমান থাকলে আশংকা করা হয় পদ্মা এবং পদ্মা শাসিত অঞ্চলে ইলিশ মাছ আদৌ পাওয়া যাবে না।
-
জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে সমুদ্রের পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বাংলাদেশের জন্যে দুধারী তলোয়ারের মত কাজ করছে। একদিকে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে উপকূল অঞ্চল তলিয়ে যাচ্ছে আর অন্য দিকে বাংলাদেশের সমতল ভূমির ক্রমান্বয়ে দেবে যাচ্ছে । এই দেবে হার বছরে ৫ মি.মি.। নদীর প্লাবনের কারণে সঞ্চিত পলি সাবসিডেনস বা দেবে যাবার নেতিবাচক প্রভাবকে এতকাল পুষিয়ে নিয়ে আসছিল। ফারাক্কার বাঁধের কারনে পলি কমে আসার কারণে এমনটি আর স্বাভাবিক হতে পারছে না ।
-
টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর টোশিও ইসুজুকা ও আমাদের যৌথ গবেষণায় ষ্ট্রনসিয়াম আইসোটপ সমীক্ষার মাধ্যমে দেখা যায় যে পুরো বঙ্গোপসাগর জুড়ে সময় অনুচক্রে তীব্র ফাইটোপ্লাকটন বিকাশ ঘটে। আর এর অনুঘটক হচ্ছে নদী বাহিত নিউট্রিয়েন্ট বা পুষ্টি উপাদান ও মিনারেল। ফারাক্কা বাঁধের কারণে এই অনুচক্র প্রক্রিয়াটি ব্যাঘাত ঘটছে । এর ফলে সমগ্র বঙ্গোপসাগর জুড়ে মৎস্য উৎপাদন আশংকাজনকভাবে কমে যেতে পারে বলে জানান।
-
প্রফেসর কেট ক্র্যান্ক (কানাডা) এর সাথে যৌথ গবেষণায় দেখা যায় যে ফারাক্কার কারণে নদী বাহিত পলির গ্রেইন সাইজ স্পেকট্রাল প্যার্টান অর্থাৎ পলি কণার সাইজ এর তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটছে। এই পরিবর্তন বাংলাদেশের মাটির ভৌত কাঠামোর উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে ।
ফারাক্কা বাঁধের কারনে আরো নানা বিধ সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। নিচে এর কিছু নমুনা উল্লেখ করা হল।
বিশাল এলাকায় মরুকরণ
পদ্মা ও তার শাখা প্রশাখার পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের উত্তর অঞ্চল বিশেষ করে রাজশাহী, চাপাইনবাবগঞ্জ ভূগর্ভস্থ পানির প্রথম স্তর ৮-১০ ফুট জায়গা বিশেষে ১৫ ফুট নীচে নেমে গেছে । বৃষ্টিপাতের পরিমান কমে যাওয়ায় এই পানির স্তর পূরণ হচ্ছে না। ২য় স্তর হল ৩০০ ফুট। খরার সময় বরেন্দ ভূমিতে এই পানি দিয়ে সেচ কাজ চালানো হলেও কত দিন চালানো যাবে তা নিয়ে কোন পূর্বাভাস করা যাচ্ছে না। পানির অভাবে মাটির আদ্রতা শুষ্ক মওসুমে ৩৫% কমে গেছে। পানি প্রবাহের এমন করুণ অবস্থা থেকে সৃষ্ট হয় মরুকরণ প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া দ্রুত এগিয়ে চলছে। আদ্রতার অভাবে দিনের নিম্নতম এবং উচ্চতম তাপমাত্রার তারতম্য বৃদ্ধি পায়। ৬০ দশকে এই তারতম্য যেখানে ৫-৮ সে. ছিল এখন সেটা বৃদ্ধি পেয়ে ৮-১২ সে. এ দাঁড়িয়েছে।
নদীর নাব্যতা
ফারাক্কা পরবর্তি সময়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বহমান পদ্মা নদীর প্রবাহ চরম ব্যাঘাত ঘটে । পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় নদীর নাব্যতা কমে গেছে এর ফলে পানির মৌসমে পানি ধারন ক্ষমতা কমে যাওয়ায় প্রায়ই বড় বন্যা সম্মুখিন হতে হচ্ছে। বাংলাদেশের গড়াই নদী এখন সম্পূর্ণ ভাবে বিলুপ্ত। ফারাক্কা বাঁধের কারণে ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহার করায় গঙ্গা অববাহিকার অনেকগুলো নদী মরে গেছে বা মৃতপ্রায়। উত্তরের নদীগুলো হচ্ছে মহানন্দা, পাগলা, শিবশা, বারনাই, ঘুমনি, বড়াল ও ইছামতি নদী।
অন্য দিকে দক্ষিণে অনেক নদী হারিয়ে গেছে কিংবা মরার মত হয়ে গেছে। এই নদীগুলো হচ্ছে মাথাভাঙ্গা, গড়াই, ভৈরব, বেতনা, কোবাদা, কোদালিয়া, মধুমতি, নবগঙ্গা, চিত্রা, কচুয়া, কুমার, আড়িয়ালখাঁ, বলেশ্বর, কচা, পালং, তরাকী, রূপসা, বিশখালী, ভাদ্রা, শিবশা, চন্দনা, বেগবতী, লোহালিয়া, তেঁতুলিয়া, ভোলা, খোলপেটুয়া, ইছামতি, কালিন্দী, সাত্যক্ষরা, ধানসিঁড়ি, পশুর, শাহবাজপুর ও রায়মঙ্গল। এছাড়া শুকিয়ে গেছে প্রমত্তা পদ্মা ও যমুনা। শুকনো মওসুমে এই নদী দু’টিতে শত শত চর জেগে উঠে। ফলে নৌচলাচলের পথ হয়ে পড়ে সীমিত। শিবালয় ও দৌলতদিয়া ফেরি চলাচল বজায় রাখার জন্য সারাবছর ড্রেজিং করতে হয়।
মাটির লবণাক্ততা
ফারাক্কা বাঁধের ফলে নদিতে পানির প্রবাহ কমে গেছে এর ফলে সমুদ্র উপকূলবর্তী বাংলাদেশের খুলনা অঞ্চলের মাটির লবনাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের আগে খুলনার আশপাশে লবণাক্ততার পরিমাণ ছিল ৫০০ মাইক্রোমোস এবং ফারাক্কার পানি প্রত্যাহারের ফলে খুলনার লবণাক্ততা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯ হাজার ৫০০ মাইক্রোমোস। তাছাড়া, মিঠা পানির সরবরাহ কমে যাওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে লবন ভূ-অভ্যন্তরস্থ পানিতে প্রবেশ করছে।
সুন্দরবন
সুন্দরবন সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন। এটি বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে আজ স্বীকৃত। ফারাক্কা বাঁধের ফলে সুন্দরবন অঞ্চলে পলি ও পানি প্রবাহে যে ব্যাঘাত ঘটেছে তার ফলে সুন্দরবনের অস্তিত্বই বিপন্ন হওয়ার মুখে। লবনাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় সুন্দরবনের ইকো সিস্টেমে ব্যাঘাত ঘটছে।
কৃষি কাজে ব্যাঘাত
বাংলাদেশ কৃষি ভিত্তিক দেশ। এই কৃষির উপর ফারাক্কার প্রভাব সবচেয়ে ভয়াবহ। ফারাক্কার প্রভাবে পানির স্তর অনেক নীচে নেমে যাওয়ার দক্ষিণ অঞ্চলের জি-কে সেচ প্রকল্প মারাত্বক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। পদ্মার পানি দিয়ে এই প্রজেক্টের কৃষিকাজ পরিচালিত হতো। কিন্তু আজ সে এলাকায় পদ্মার পানি পাওয়া যাচ্ছে না। ঐ অঞ্চলের সেচযন্ত্র গুলো হয়ত বন্ধ হয়ে আছে অথবা যেগুলো চালু আছে সে গুলোর উপর তার ক্ষমতার চাইতে বেশি চাপ পড়ছে। মাটির আর্দ্রতা, লবনাক্ততা, মিঠা পানির অপ্রাপ্যতা কৃষির মারাত্বক ক্ষতি করেছে।
এছাড়া ফারাক্কা বাঁধের ফলে উজান থেকে বাংলাদেশ আসা গঙ্গাবাহিত পলির পরিমাণ গত শতকের ষাটের দশকের তুলনায় বার্ষিক পলির পরিমাণ বর্তমানে অর্ধেকে (দুই বিলিয়ন টন থেকে এক বিলিয়ন টন) নেমে এসেছে। যার ফলে কৃষি জমির প্রাকৃতিক উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে।
মৎস্য
পানি অপসারণের ফলে পদ্মা ও এর শাখা-প্রশাখাগুলোর প্রবাহের ধরণ, পানি প্রবাহের বেগ, পানি প্রবাহের পরিমাণ , লবণাক্ততা ইত্যাদিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। এই বিষয় গুলো মাছ উৎপাদনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পদ্মা নদী শুকিয়ে যাওয়ায় একদিকে হারিয়ে যাচ্ছে দেশি জাতের মাছ, অপরদিকে পদ্মা নদীর প্রাণ ঘড়িয়াল ও শুশুক এখন বিলুপ্ত প্রায়। ফারাক্কা বাঁধের জন্য মাছের সরবরাহ কমে যাওয়ায় হাজার হাজার জেলে বেকার হয়ে পড়েছে। এর প্রভাব অন্যখাত গুলোর উপরও পড়েছে।
নৌ-পরিবহন
বাংলাদেশ নদিমাতৃক দেশ। দেশের অনেক এলাকার যোগাযোগ নদী নির্ভর। নদীর নাব্য কমে আসা, পানির প্রবাহ কমে আসার ফলে নৌ যোগাযোগ ব্যহত হচ্ছে। এর অনেক লোক বেকার হয়ে পড়েছে, যোগাযোগে সমস্যা হচ্ছে ও নৌ-পরিবহনের খরচ বেড়ে যায়।
শেষ কথা
বারবার পদ্মা নদীর গতিধারা পরিবর্তনের কারণে নদী ভাঙনের শিকার হচ্ছে ওই এলাকার মানুষ, হারাচ্ছে ফসলি জমি। ফারাক্কা শুধু বাংলাদেশের জন্যে মরণ ফাঁদ হয়ে উঠে নি। ভারতও এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলো ভারতের ফারাক্কা সংলগ্ন এলাকাগুলোতে বন্যাই তার প্রমাণ দেয়। ফারাক্কা বাঁধ বাংলাদেশের মানুষের কাছে ভারতের পানি আগ্রাসনের প্রতীক। ভারত সরকার একে একটি আঞ্চলিক ভূ রাজনীতি হিসেবে জিইয়ে রেখেছে। বাংলাদেশকে ফারাক্কা সমস্যা থেকে যত তারাতারি সম্ভব পরিত্রাণের স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। আরও আশা করা যায় , গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকার সব মানুষ (ভারত-বাংলাদেশের মানুষ) তাদের ভৌগলিক সীমারেখার ঊর্ধ্বে উঠে পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষায় একসঙ্গে কাজ করতে এগিয়ে আসবে।
তথ্যঃ উইকি, বিভিন্ন অনলাইন পোর্টাল।