মাসুদ রানা সিরিজঃ ৫০ পেরিয়েও একজন যুবক!

১২ বছরের ইতালিয়ান মেয়ে লুবনা আভান্তি। বাবা ভিটো আভান্তি ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত আর মা লরা আভান্তি ব্যস্ত সমাজে নিজের স্ট্যাটাস রক্ষায়।যার রুপের কোন তুলনা হয় না।  অভিজাত সমাজে তাকে বলা হয় নিয়াপলিটান সৌন্দর্যের উৎকৃষ্ট নমুনা ।

লুবনা আভান্তি মায়ের সমস্ত সৌন্দর্য পেয়েছে তবে স্বভাবে রয়েছে প্রচুর অমিল লরার চেহারায় রয়েছে গর্ব, মেয়ের চেহারার সারল্য মায়ের চোখে তির্যক কটাক্ষ আর মেয়ে চোখে মায়া।  মা আত্মকেন্দ্রিক নিজেকে নিজের মধ্যে গুটিয়ে রাখে আর মেয়ে নিজেকে প্রকাশ করার জন্যে ছটছট করে করে বেড়ায় । লুবনার সঙ্গী নেই কেউ।

বন্ধু বান্ধবহীন এ এক শ্বাসরুদ্ধকর বন্দি জীবন যে বয়সে তার বন্ধু-বান্ধব আর খেলার সাথী দরকার সেই বয়সে তার বাড়ির বাইরে পা বাড়ানো নিষেধ।  বাবা থাকলে বাবার দেখা পাওয়া আর দশটা ধনী বেনেয়াদী পরিবারের মত ভাগ্যের ব্যাপার বাবা ব্যবসার কাজে বছরের বেশিরভাগ সময় বাইরেই থাকে আর ঘরে ফিরলেও তার মা থাকে দখল করে রাখে লুবনা দেওয়ার মত সময় তার হাতে নেই।

অন্য দিকে মা লরা থেকেও নেই নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত ইতালিতে ধনি পরিবারের বেশ কিছু ছেলে মেয়ে কিডন্যাপ হবার পরে বডিগার্ড রাখাটা অনেকের কাছেই ফ্যাশন হয়ে দাড়িয়েছে ।  এমন সময় লুবনার মা লরা লুবনার জন্যে ভিটো আভান্তির কাছে বডি গার্ড রাখার জেদ ধরে । ব্যাপারটা এমন নয় যে লুবনার নিরাপত্তাই বড় ইস্যু আসল কথা আশে পাশের আর দশটা ধনি পরিবারের বডিগার্ড আছে তাই লুবনার জন্যেও বডিগার্ড রাখতে হবে তা না হলে ডাট বজায় থাকে না !

এমনি সময়, ক্রমবর্ধমান অপহরণের ভয়ে আর খানিকটা স্ট্যাটাসের খাতিরে লুবনার জন্য নিয়োগ দেয়া হল এক বডিগার্ড- ইমরুল হাসান। কেমন করে ভীনদেশী যুবক হাসান আর ছোট্ট মেয়ে লুবনার বন্ধুত্ব হলো তাই দিয়ে এ কাহিনী শুরু।

সিআইএ এর মুখের সামনে থেকে সোভিয়েত মিগ ছিনতাই করে আনায় , সিআইএ আর মোসাদ মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে পাগলা কুকুরের মত খুঁজে বেড়াচ্ছে ইমরুলকে।   ইটালিতে এক বন্ধুর কাছে লুকিয়ে ছিল ইমরুল ।সারা দিন-রাত মদ নিয়েই আছে। বন্ধু রেমারিকের অনুরোধে সে লুবনার বডিগার্ডের চাকরী নেয়। নিঃসঙ্গ ছোট্ট মেয়েটি ইমরুলকে পেয়ে খুব খুশি হয়। কারন তাকে সময় দেয়ার মত সময় তার বাবা-মার ছিল না তাই।

নামমাত্র পারিশ্রমিকে লুবনার বডিগার্ডের চাকরিটা নিয়ে নিল ইমরুল । চাইছিল চুপচাপ কাটিয়ে দেবে সময়টা।  অনিচ্ছা থাকা স্বত্ত্বেও পাগলী মেয়েটা আস্তে আস্তে দখল করে নিলো ইমরুলকে। কখন যে ওরা বন্ধু হয়ে গেল, স্নেহের কাঙাল মেয়েটা কখন যে তাকে হিদয়র বাঁধনে বেঁধে নিল বুঝতেইপারলো না ইমরুল। লুবনার সাথে ব্যাপারটা ছিল এক ধরনের স্নেহ মাখা ভালবাসা-বন্ধুত্ব।

বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরুপ একদিন লুবনা ইমরুলের জন্মদিনে লুবনাকে নিয়ে বেড়াতে বের হয়।  মেয়েটা তার কষ্ট করে জমানো টাকা দিয়ে একটা গিফট বক্স দেয়।  সোনালি প্যাকেটা খুলে প্রথমে একটা ক্যাসেট প্লেয়ার বের করল, সাথে আছে লুবনার ছোটবেলা থেকা তুলা প্রায় সব ছবির একটা এলবাম।  লুবনা ইমরুলের দিকে তাকিয়ে হাসল অনেকগুলো ছবি কাঁচি দিয়ে কাটা, লুবনার পাশে যে বা যারা ছিল তারা বাদ পড়েছে । বাড়ির সবার সাথে ছবি রয়েছে শুধু নেই তার মায়ের সাথে তোলা কোন ছবি ! কাটা অংশে কে ছিল স্পষ্টই বুঝা যায় !

আর রয়েছে কালো মখমল কাপড়ে মোড়া একটি খুদে বাক্স বাক্স খুলে ইমরুল খুব অবাক হয়ে গেল।  ভেতরে রয়েছে খুব ছোট একটা কোরআন শরিফ, ইংরেজি অনুবাদ সহ, সাথে আছে চককে ইস্পাতের হাতলওয়ালা একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস । টুইন ওয়ানে ক্যাসেট ভরে লুবনা ক্যাসেট প্লেয়ার অন করল।  ইতালির গান কিং ইংরেজিতে গাওয়া গান শুনতে শুনতে ইমরুল চলে গেল অন্য জগতে।

 “এক সময় থেমে যাবে সমস্ত কোলাহল, ঘুমিয়ে পড়বে ধরণী। আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাটা মিটমিট করলে বুঝবে আমি তোমায় ডাকছি। সে রাতে তুমি জেগে থেকো, বন্ধু, ঘুমিয়ে পোড়ো না। আর, হ্যাঁ, ফুলের গন্ধ পেলে বুঝে নিয়ো আমি আসছি। আর যদি কোকিল ডাকে, ভেব আমি আর বেশী দূরে নেই। তারপর হঠাৎ ফুরফুরে বাতাস এসে তোমার গায়ে লুটিয়ে পড়লে, বুঝবে আমি এসেছি। সে রাতে তুমি জেগে থেকো, বন্ধু, ঘুমিয়ে পোড়ো না।”

গান শেষ হবার পর অনেকক্ষণ কেউ কোন কথা বলল না। তারপর বিষণ্ন একটু হেসে লুবনা নিস্তব্ধতা ভাঙল, ‘তুমি আমাকে ঘুম পাড়াতে চাও, তাই না, হাসান? কিন্তু আমি তোমাকে জাগিয়ে রাখতে চাই। একদিন ছাড়াছাড়ি হবে, তখন কিন্তু আমার কথা ভুলে যেয়ো না। গানের কথাগুলো শুনলে তো? সব চেয়ে বড় তারাটা মিট মিট করলে বুঝবে সত্যিই আমি তোমাকে জেগে থাকতে বলছি।’

ভালই কাটছিল দিনগুলো, হাসি-আনন্দে। হঠাৎ একদিন, সত্যি সত্যিই অপহরণের শিকার হলো লুবনা। ছয়মাস সব ধরনের ট্রেনিংয়ের বাইরে থাকা  ইমরুল উপস্থিত থেকেও ঠেকাতে পারলো না। দু’জন অপহরণকারী তার হাতে মারা গেলেও অন্য দু’জনের গুলিতে গুরুতর আহত হল সে। বাঁচার আশা ছেড়ে দিলেন ডাক্তারেরা। হাসপাতালের বেডে শুয়েই ইমরুল শুনতে পেল লুবনাকে মেরে ফেলা হয়েছে, মৃত্যুর আগে বাচ্চা ্মেয়েটা রেপের শিকার! প্রতিশোধের আগুন  ইমরুলের ভেতরে বেঁচে থাকার তীব্র আকূতি তৈরী করে দিল। ডাক্তারদের ধারনাকে ভুল প্রমান করে বেঁচে উঠলো ইমরুল !

দুঃখী মেয়েটার মৃত্যুর জন্য এবার ইমরুলের প্রতিশোধ নেবার পালা। বন্ধু রেমারিকের পরামর্শে চলে গেল গোজো, রেমারিকের শ্বশুর বাড়ি। উদ্দেশ্য প্রতিশোধ শুরুর আগে শরীরটাকে ঝালিয়ে আবার আগের মত ক্ষুরধার করে তোলা। কিন্তু, ঐ গানটা তাকে ঘুমাতে দেয় না। আপন মনে সে বলে ওঠে, “জেগে আছি, আমি জেগে আছি।”

গোজোতে এক মাসের নিবিড় অনুশীলন ইমরুলকে আগের মতই ইস্পাতে পরিণত করে। সেখানে তার প্রেমে পড়ে ভায়োলা। কিন্তু ইমরুল , “একা। টানে সবাইকে কিন্তু বাঁধনে জড়ায় না।” তারপরেও গোজো থেকে ফিরবার আগে ভায়োলা তাকে দিয়ে আবার গোজোতে ফিরে আসবার প্রতিজ্ঞা করিয়ে নেয়।

ইটালিতে ফিরে লুবনা অপহরণের সাথে জড়িত প্রতিটি ব্যক্তির বিরুদ্ধে নির্জলা যুদ্ধ ঘোষনা করে ইমরুল। বন্ধু রেমারিক আর গগলের কাছ হতে একগাদা অস্ত্র নিয়ে শুরু হয় তার মিশন। ছোট পুঁটি হতে শুরু করে বড় রুই-কাৎলা কেউই রেহাই পাবে না তার হাতে। আর তাই করতে গিয়ে সে আবিষ্কার করে এ অপ্রিয় সত্য।

লোভী উকিল লোরানের পরামর্শে বাবা ভিটো আভান্তি নিজেই মাফিয়াকে দিয়ে লুবনাকে অপহরণ করায়! উদ্দেশ্য, লুবনার নামে করা ইন্সুরেন্সের টাকা দিয়ে ডুবতে বসা ব্যবসাকে আবার চাঙা করে তোলা। কিন্তু, লুবনার মৃত্যু সবকিছুকে এলোমেলো করে দেয়। লোরান মারা যায়  ইমরুলের হাতে, আর ভিটো আত্মহত্যা করে। ইমরুলের হাতে একে একে মারা যায়, অগাস্টিন, এলি, বেরলিংগার। ইতালীয়ান মাফিয়ার ভীত কেঁপে ওঠে। কিন্তু, ইমরুলের হাত হতে নিস্তার নেই। লুবনার জন্য এখনো তার হৃদয়ে রক্তক্ষরন; এখনো সেই গানটা তাকে ঘুমাতে দেয় না।

রাতা রাতি ফ্যান ক্লাব গড়ে উঠে, আমেরিকাতে যুব সংগঠনগুলো চাঁদা তোলার জন্যে রাস্তায় নেমে আসে, প্রতিটি দলের সংগে একটা করে ব্যানার, তাতে লেখা, – ‘একজন নিংসংগ মানবদরদীকে সহায়তা করুন- সে আহত হলে তার চিকিৎসা লাগবে, গ্রেফতার হলে আইনগত সহায়তা দরকার হবে’.  দুনিয়ার প্রথম দিনেই কয়েক লক্ষ ডলার চাঁদা উঠল। একজন আর্মস ব্যবসায়ী ঘোষণা করল, সে একাই আড়াই লাখ ডলার দান করবে। তার দেখাদেখি আরো কয়েকজন ব্যবসায়ী এগিয়ে এল, ঘোষণা করল মোটা অংকের চাঁদা। বলতে গেলে, কে কত বেশি দিতে পারে , তার একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল, কিন্তু  মুশকিল, কেউ জানে না ক কোথায় পাটাহতে হবে টাকা বেশিভাগ যুব সংঘটনগুলো তাদের টাকা পাঠিয়ে দিল সংবাদপত্র অফিসে ।

ইটালির মানুষ মানুষ আরও কল্পনা শক্তির পরিচয় দিল। স্টিকার তো ছাপা হলই, রাস্তার মোড়ে মোড়ে বিশাল আকৃতির তোরণ নির্মাণ করল তারা তোরণের মাথায় সোনালি জরি দিয়ে কিছু না কিছু লিখা হল একটা তোরণে পাড়ার ছেলেরা লিখল ” বাঙ্গালী বীর, লহ সালাম”। রোমের সবচেয়ে বড় চৌরাস্তায় যে প্রকান্ড তোরনটা তৈরি হল তার মাতাহ্য বড় বড় অক্ষরে লেখা থাকল ” লুবনার জন্যে আমরাও কাঁদি।”

ডন বাকালাও এ অপহরণের সাথে জড়িত ছিল। অতএব, সবশেষে মৃত্যুর পরোয়ানা মাথায় নিয়ে ইমরুল বাকালার দূর্গে ঢুকে পড়ে। ধূলোয় মিশিয়ে দেয় অত্যাচারের প্রাসাদ। গুরুতর আহতাবস্থায়ও পিষে মারে বাকালাকে। প্রতিশোধ শেষ ইমরুলের । অজ্ঞান হয়ে যাবার আগে বিড়বিড় করে রানা বলে ওঠে, “এবার আমি ঘুমাব, লুবনা, এবার আমি ঘুমাব।”

মাফিয়ার হাত হতে ইমরুলকে রক্ষার জন্য তার মৃত্যুর একটা ক্যামোফ্লেজ তৈরী করা হয়। পত্রিকায় ছাপানো হয়,”এদেশের মিষ্টি এক মেয়ে একটা গান উপহার দিয়েছিল বাংলাদেশের এক দুঃসাহসী যুবককে।……..এই পবিত্র ভালবাসার মর্যাদা রক্ষা করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে সেই বিদেশী যুবক। 

আশা করি সবাই বুঝতে পারছেন কার কথা বলা হচ্ছে , কে এই ইমরুল হাসান। কি তার পরিচয় ! কারো বুঝতে সমস্যা হচ্ছে ?

মাসুদ রানা বাংলাদেশে কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের এক দুর্দান্ত দুঃসাহসী স্পাই। গোপন মিশন নিয়ে ঘুরে বেড়ায় দেশ-দেশান্তরে। বিচিত্র তার জীবন। অদ্ভুত রহস্যময় তার গতিবিধি। কোমলে কঠোরে মেশানো নিষ্ঠুর সুন্দর এক অন্তর। একা। টানে সবাইকে কিন্তু বাঁধনে জড়ায় না। কোথাও অন্যায়- অবিচার-অত্যাচার দেখলে রুখে দাঁড়ায়। পদে-পদে তার বিপদ-শিহরন-ভয় আর মৃত্যুর হাতছানি। 

এ লাইন ক’টা পড়ে শিহরিত হয়নি, মাসুদ রানার এমন পাঠক নেই। হ্যাঁ এতক্ষণ মাসুদ রানার একটা বই থেকে সারসংক্ষেপ তুলে ধরার চেষ্টা করছি।  কাজী আনোয়ার হোসেনের লেখা একটা সিরিজ হল মাসুদ রানা । উপরের ঘটনা “অগ্নিপুরুষ” নামে একটা বই থেকে তুলে ধরা হয়েছে। আমার পড়া সেরা বইয়ের একটা হল অগ্নিপুরুষ।

অগ্নিপুরুষে মানবিক আবেদনটা আনোয়ার হোসেন খুব ভাল  ভাবে ফুটিয়ে তুলছেন। এই বইতে মাসুদ রানার আবেগকে এত ভাল করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যে, সিরিজের অন্য বইয়ের তুলনায় তাকে আমার অনেক বেশী রক্ত-মাংসের মানুষ বলে মনে হয়েছে।

বইটা পড়ে কাঁদেনি এমন পাঠক বিরল।  আমিও কেঁদেছি।  বইটা একটা বিদেশী কাহিনীর অ্যাডাপ্টেশন। মূল বইয়ের নাম ম্যান অন ফায়ার। এটি অবলম্বন করে হুমায়ূন আহমেদও বই লিখেছেন: অমানুষ। আ ম্যান অন ফায়ার চলচ্চিত্রায়িতও হয়েছে, মূল ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ডেঞ্জেল ওয়াশিংটন। শুধু তাই নয়, একই কাহিনি অবলম্বনে ছবি হয়েছে বলিউডেও: ইক আজনবী। মূল ভূমিকায় ছিলেন অমিতাভ বচ্চন। তিন গোয়েন্দা, মাসুদ রানা সিরিজ সেবা প্রকাশনীর অনবদ্য সৃষ্টি।  আমার পাঠক হয়ে উঠার পিছনে সেবা প্রকাশনীর বিরাট অবদান আছে।

মাসুদ রানার জন্ম

মাসুদ রানা। কেবল একটি নাম নয়। এর সাথে জড়িয়ে আছে কম বেশি এ দেশের বহু বইপ্রেমী পাঠকের কৈশোরের স্মৃতি। মাসুদ রানার  কোড নেম এমআর নাইন । কাল পরিক্রমায় বহু পাঠক হারিয়ে গেলেও সেই হারিয়ে যাওয়া পাঠকের স্থান দখল করতে চলে আসছে নতুন পাঠক ।  এই রহস্য – রোমাঞ্চ সিরিজের পেছনের মানুষটি অগণিত পাঠকের মনে জায়গা করে আছে পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে।

১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে ধ্বংস পাহাড় প্রচ্ছদনামের প্রথম গ্রন্থটি থেকে শুরু করে সেবা প্রকাশনী থেকে মাসুদ রানা সিরিজে এই চরিত্রকে নিয়ে সাড়ে চারশর বেশি গুপ্তচরবৃত্তীয় কাহিনীর বই প্রকাশিত হয়েছে। সিরিজের প্রথম দুইটি বই মৌলিক হলেও পরবর্তীতে ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষার বইয়ের ভাবানুবাদ বা ছায়া অবলম্বনে রচিত হয় । কাজীদা  মাসুদ রানার চরিত্রটিকে মূলত ইয়ান ফ্লেমিংয়ের সৃষ্ট জেমস বন্ড চরিত্রটির বাঙালি সংস্করণ হিসেবে সৃষ্টি করেছিলেন । কিন্ত বর্তমানে মাসুদ রানা বাংলা সাহিত্যের একটি শক্তিশালী চরিত্র।

মাসুদ রানাকে বলা যায় বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো, দীর্ঘস্থায়ী ও জনপ্রিয় সুপার-হিরো চরিত্র, যার পক্ষে অসম্ভব বলে কিছুই নেই, যে কখনো পরাজিত হয় না, যার মৃত্যু হয়না।  আর  রানার বসের চরিত্রে রয়েছেন মে. জে. রাহাত খান। তিনি ‘বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স’ বা বিসিআই নামে একটি কাল্পনিক গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ ব্যক্তি।  ঢাকার মতিঝিলে এই সংস্থার প্রধান অফিস . এখানে এসেই সবসময় বসের কাছে রিপোর্ট করতে হয় রানাকে। রাহাত খানকে সবসময়েই বর্ণনা করা হয়েছে অত্যন্ত জলদগম্ভীর এক অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল হিসেবে, যার ঠোঁটে সবসময় থাকে টোব্যাকো পাইপ বা চুরুট।

মাসুদ রানা’র প্রথম বইটি কাজী আনোয়ার হোসেনের ১০ মাসের দীর্ঘ পরিশ্রমের ফসল। তিনি ঐ সময়ে মোটরসাইকেলে তাঁর রাঙ্গামাটি ভ্রমণের কথা স্মরণ করে লেখেন উপন্যাসটি। আর ঐ কাহিনীই বাংলা সাহিত্যের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।

আনোয়ার হোসেন ২০১১ সালে তার এক সাক্ষাৎকারে  মাসুদ রানা সিরিজ লেখার পেছনে ‘মাহবুব আমিন’ নামের এক বন্ধুর অবদানের কথা  উল্লেখ করেছেন । তিনি কাজী আনোয়ার হোসেন কে জেমস বন্ড সিরিজের ‘ডক্টর নো’ বইটি কিনে দিয়ে বলেছিলেন পড়ে দেখতে দেশের বাইরের লেখার ধরন কতটুকু এগিয়ে গেছে। ১৯৯৮ সালের দিকে এক সাক্ষাৎকারে কাজীদা মাসুদ রানা চরিত্র সৃষ্টিতে জেমস বন্ডের কথা উল্লেখ করেন।

“ধ্বংস পাহাড়” লিখার প্লট আসে কুয়াশা সিরিজের আদলে,

এক প্রতিভাবান বিজ্ঞানী কাপ্তাই শহরের কাছে একটা পাহাড়ের ভেতর অ্যান্টি-গ্র্যাভিটি নিয়ে গোপন গবেষণা করছিলো। কাপ্তাই বাঁধ তৈরির ফলে বিশাল লেকের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে পাহাড়টা। তাই সে সিদ্ধান্ত নিলো পাকিস্তানের কোনো শত্রু দেশের সরবরাহ করা শক্তিশালী ডিনামাইট ফাটিয়ে উড়িয়ে দেবে বাঁধটা। আর সেটা ঠেকাবে বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স এজেন্ট মাসুদ রানা।

এই প্লটকে বস্তবরুপ দিতে  আনোয়ার হোসেন নিজের বাইক নিয়ে ঘুরে বেড়াতে শুরু করলেন চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, কাপ্তাই, কক্সবাজার প্রভৃতি স্থানে।  সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখা দেয় সে সময় বাংলা ভাষায়  এ রকম স্টাইলে লেখার চল ছিল না। আনোয়ার হোসেন তাই নিজের লেখায় ঠিক সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না, বারবার কাটাকাটি করে পাণ্ডুলিপির চেহারাটাই বিগড়ে দিলেন।

দীর্ঘ সময় নিয়ে নিজস্ব ঢঙ্গয়ে তৃতীয়বার পরিষ্কার করে আবার লিখলেন গোটা কাহিনীটাই। শেষ পর্যন্ত নিজের অসন্তুষ্টি নিয়েই ছাপার জন্য প্রেসে দিয়েছিলেন, এমনকি প্রুফ রিড করার সময়ও প্রচুর সম্পাদনা করেছিলেন লেখক। এমনকি প্রকাশিত অবস্থায় হাতে পাওয়া বইটিতেও লেখক নিজে সন্তুষ্ট ছিলেন না। নিজে সন্তুষ্ট না থাকলেও পাঠক বইটি সাদরে গ্রহণ করে।

যেভাবে নাম আসে মাসুদ রানা সিরিজের নানা নাম

কেন মাসুদ রানা অন্য কোন নাম নয় ? যে কোন নামই তো হতে পারত।

মাসুদ রানা’র নামকরণ করা হয় দুজন বাস্তব মানুষের নামের অংশ মিলিয়ে। কাজী আনোয়ার হোসেন তাঁর স্ত্রী, আধুনিক সংগীতশিল্পী ফরিদা ইয়াসমীনের সাথে পরামর্শ করে নামটি নির্বাচন করেন। এপ্রসঙ্গে স্বয়ং কাজী আনোয়ার হোসেন বলেন

মাসুদ রানা নামটি এসেছে তাঁর এক গীতিকার বন্ধু ‘মাসুদ করিমের’ নামের প্রথম অংশ এবং ভারতের প্রখ্যাত রাজপুত বংশের রাজা ‘রানা প্রতাপ সিং’ এর নাম থেকে। একে একে বাকি চরিতগুলোও সৃষ্টি করে ফেলেন কাজীদা, লিখে ফেলেন সিরিজের প্রথম বই ‘ধ্বংস পাহাড়’।

মজার বিষয় হলো, কাজীদা প্রায় সব চরিত্র বাস্তব কারও কাছে ধার করেছেন। যেমন, বাস্তবের রাহাত খান একজন সাংবাদিক! তিনি বাংলাদেশের একজন সুপরিচিত কথাসাহিত্যিক এবং প্রবীণ সাংবাদিক রাহাত খান।কাজী আনোয়ার হোসেনের সহপাঠী ও অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু । বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা বাসসের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি এবং দৈনিক বর্তমান নামে একটি সংবাদপত্রের উপদেষ্টা সম্পাদক।

ওনার মুখ থেকেই জানা গেল, যাদের সঙ্গে কাজীদার সম্পর্ক ভালো ছিল, তাদের রানার আশেপাশে রেখেছেন বন্ধুবেশে। 😀 😀  আর যাদের সঙ্গে শত্রুতা ছিল তাদের নামে চরিত্র সৃষ্টি করে বানিয়ে দিয়েছেন রানার শত্রু!

অবশ্য রানার চিরশত্রু কবীর চৌধুরীর বাস্তবের কোনো পরিচয় আমরা আজও জানতে পারিনি। একসময় পশ্চিমবঙ্গের বাংলা বই চোরাই পথে বাংলাদেশে আসত। তখন বাংলা সাহিত্য মানেই ছিল পশ্চিমবঙ্গ। কিন্তু মাসুদ রানা আসার পর পরিস্থিতি পালটে গেল কিছুটা। কারণ মাসুদ রানার বইই তখন পশ্চিমবঙ্গে পাচার হতে লাগলো!

মাসুদ রানার ব্যক্তিগত পরিচয়

পুরো নাম মাসুদ রানা।  তাঁর সাংকেতিক নাম MR-9।  ১৯৩৬ সালের ৯ এপ্রিল জন্ম। বাবার মৃত্যুর পরে চাচা আর ফুপুর কাছে লন্ডনে বড় হয় সে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞানের উপর লেখাপড়া শেষ করে, ব্রিটেনেই আর্মি ট্রেনিং নেয় সে। এর পর বাংলাদেশ (১৯৬৬ সালে প্রকাশিত বইয়ে পাকিস্তান সেনা বাহিনী ছিল) সেনা বাহিনীতে যোগ দেয় ১৯৫৬ সালে। এক বছরের মাথায় আর্মি ইন্টেলিজেন্সে নিয়ে নেওয়া হয় তাকে।

১৯৬১ সালে মেজর পদে থাকা কালীন, বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের(বিসিআই)অনুরধে সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে যোগ দেয় সে। বিশ্বের মোটামুটি সব দেশেই কাজ করে খ্যাতি অর্জন করেছে রানা। ওনেক দেশে বিসিআই এর ছদ্মনামের অফিস ‘রানা এজেন্সি’ এর কর্ণধার সে।  উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বে তথা ১৯৭১-এর আগের বইগুলোতে সংস্থাটির উল্লেখ থাকতো পি.সি.আই বা “পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স” হিসেবে।

বইয়ের বিবরণ অনুযায়ী লম্বায় সে পাঁচ ফিট এগারো, কালো চুল আর চোখ। বয়স ত্রিশের কোঠা কোনদিন পাড় হয়নি তার। চেহারায় দৃঢ়টা, আত্মবিশ্বাস কোনটার কমতি নেই।  অভিজ্ঞ একজন সৈনিক, দক্ষ অধিনায়ক, অসাধারণ প্রেমিক আর কোমল মনের একজন মানুষ মাসুদ রানা।

মাসুদ রানা সিরিজ লিখতে গিয়ে বাধা !

স্পাই থ্রিলারধর্মী এই মাসুদ রানা সিরিজে রহস্যের মারপ্যাঁচ যেমন আছে তেমনি আছে চোখ ঝলসানো সব গাড়ি, অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার ।  দেশের বাইরের বিভিন্ন দৃশ্যের বিবরণ এতোটাই সূক্ষ্ম ভাবে দেয়া থাকে যে মনে হয় চোখের সামনেই দেখছি অজানা কত দৃশ্যকে।

মাসুদ রানা সিরিজটি প্রথম দিকে শুরু করা হয়েছি মূলত প্রাপ্ত বয়স্কদের অবসরের সংগী হিসেবে চিন্তা করে। প্রথম দিকের বইগুলোতে তাই মারমারি  পাশাপাশি ছিল নায়িকাদের সাথে মাসুদ রানার মেলা মেশা। এ নিয়ে সমস্যার সৃষ্টি করে তৎকালীন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রকাশনীরা। অভিযোগ ওঠে অত্যাধিক যৌনতার বিবরণ নাকি দেয়া হচ্ছে এই সব বইয়ে। এ নিয়ে রেষারেষি এক সময় আদালত পর্যন্ত গড়ায় ।  কখনও কখনও এমনও হয় যে, মাসুদ রানা সিরিজ বন্ধ হবার উপক্রম হয়। প্রথমবার এমনটা হয়েছিলো বাংলাদেশের স্বাধীন হবার আগে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার রানার স্বর্ণমৃগ  বইটি নিষিদ্ধ (ban) করেছিলো, লেখক কাজী আনোয়ার হোসেন এতে চ্যালেঞ্জ করায় গোটা সিরিজই বন্ধ করে দেওয়ার জোগাড় করেছিলেন ক্ষুব্ধ এক সরকারি কর্মকর্তা। কিন্তু মাসুদ রানার সৃষ্টিকারী লেখক নিজেও কি রানা থেকে কম যান? তিনিও নিজের উপর আস্থা রেখে লড়ে যান সেই কেস। এ যেন তাঁর গল্পের কোন দৃশ্য। কেসে জিতে বইয়ের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলিয়ে নেন এক সময়।

দ্বিতীয়বার সমস্যায় পড়তে হয় মুক্তিযুদ্ধের পর,  সে সময় নানা লোকজন টেলিফোনে হুমকি দিতে শুরু করেছিলো, কেননা স্বাধীনতার আগে ভারত পাকিস্থানের শত্রু ভাবাপন্ন দেশ থাকলেও যুদ্ধের সময়কার অন্যতম মিত্র দেশ ভারত, স্বাধীনতার পরে নিকটবর্তী বন্ধু দেশ হিসেবে পরিচিতি পায়। এতে সিরিজের প্রথম দিককার বইগুলোতে ভারতকে শত্রুপক্ষ করে সাজানো কাহিনীগুলো সাধারণ্যের রোষানলে পড়ে।

তখন বাধ্য হয়ে কাজীদা প্রথম দিককার কয়েকটি বই থেকে ভারতবিরোধী অংশগুলো বর্জন করে নেন, এমনকি ২টি বই পুণর্লিখনও করা হয়েছিলো। তৃতীয়বার, প্লট সংকটের কারণে আটকে গিয়েছিলো সিরিজটি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ( কোনো দেশ আর বাংলাদেশের শত্রু রইল না, অথচ শত্রুদেশ ছাড়া গুপ্তচর-কাহিনী হয় না। সে সময় কাজী দা রানাকে দিয়ে রানা ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি খুলে গুপ্তচরবৃত্তির পাশা পাশি গোয়েন্দা, অ্যাডভেঞ্চার, ট্রেজার-হান্ট, এমনকি বিজ্ঞানকল্প ও পিশাচ কাহিনী টেনে আনেন।

সময়ের সাথে তাল রেখে বইয়ের লেখনিতে পরিবর্তন আসে। যে সময় মাসুদ রানার আবির্ভাব সে সময় টেলিভিশন আর টেলিফোন ছিল দুষ্প্রাপ্য বিষয়, কিন্তু পাঠকের চিন্তা ধারার সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়ে মাসুদ রানাও প্রবেশ করেছে স্মার্ট ফোন আর দ্রুত গতির ইন্টারনেটের যুগে। এখনকার বইগুলোতে হয়তো প্রথম বই গুলোর মত আবেগঘন রোমান্স দেখা যায়না, কিন্তু তাই বলে রূপবতী নায়িকাদের ঝলক কিংবা জীবন বাজী রেখে এগিয়ে যাওয়ার কাহিনীর কমতি নেই।

সহায়ক চরিত্রগুলো

রানা সিরিজের বই গুলোতে নিত্য নতুন অনেক চরিত্রের আনাগোনা থাকলেও কিছু চরিত্র সবসময় অমলিন। প্রধান সহায়ক চরিত্রগুলো হলঃ

মেজর জেনারেল রাহাত খান

বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টিলিজেন্স এর চিফ হলেন রাহাত খান। রাহাত খান তরুন অবস্থায় ব্রিটিশ ভারতের মিলিটারী ইন্টালিজেন্সে ছিলেন,এবং ব্রিটিশ ভারতের হয়ে দ্বীতিয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ গ্রহন করেন।  বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাকে দেখা যায় নিজের কেবিনে এক গাদা ফাইলের মাঝে মুখ গুজে মিষ্টি গন্ধের তামাক ভরা পাইপ খেতে ।  রাহাত খান  রানার কাছে পিতৃতুল্য ব্যক্তি। যার সামনে দাঁড়াতে এখনও বুক ঢিব ঢিব করে তার। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় কাহিনীর সাধারণত শুরুর দিকে রাহাত খানের ভূমিকা থাকে ।

রানা তার বন্ধু ব্যারিস্টার ইমতিয়াজ চৌধুরীর ছেলে।  রানাকে  নিজের ছেলে স্নেহ করেন । কিন্তু কাজের বেলায় কাউকেই ছাড় দেন না। অবশ্য রাহাত খানের নিজস্ব অভিযানের কাহিনী নিয়ে সেবার একটি সিরিজ ছিল যার নাম ‘মেজর রাহাত সিরিজ’। সময়ের সাথে সেই সিরিজ বন্ধ হয়ে গেলেও রানা সিরিজের অন্যতম চরিত্র হয়ে আছেন এবং থাকবেন দেশের জন্য নিবেদিত প্রান এই বিসিআই অধিনায়ক।

সোহেল

রাহাত খানের পর  যার নাম সবার আগে আসে তিনি হলেন রানার সবচেয়ে কাছের বন্ধু সোহেল আহমেদর। অক্সফোর্ডে লেখা পড়া একই সাথে তখন থেকেই অন্তরঙ্গ বন্ধু তারা। নিজেদের মাঝে খুনসুটি আর হাতাহাতি চললেও একে অপরের জন্য জীবন বাজি রাখতে কেউ পেছপা হয় না। এক হাত কাটা যাবার দরুন তাকে সব মিশনে সাথে দেখা যায় না। বিসিআই এর অফিশিয়াল কাজে অথবা পর্দার আড়ালে থেকে রানাকে সাহায্য করতে দেখা যায় তাকে।

সোহানা চৌধুরী

সোহানা চৌধুরী রাহাত খানের পারসোনাল সেক্রেটারী ও রানার প্রেয়সী। সোহানাও বিসিআই এর তুখোড় একজন এজেন্ট।  রানা ও সোহানার প্রথম দেখা হয় “নীল আতংক নামে বইয়ে যদিও সেখানে তাকে পাশ্ব চরিত্র হিসেবে দেখানো হয়েছে। রানা ও সোহানা প্রথম মিশনে যায় গুপ্ত চক্রে।

গিলটি মিয়া

সাগর-সঙ্গম বইটি লিখতে গিয়ে কোনো এক বই থেকে কাছাকাছি একটা চরিত্র পেয়ে  সেটাকেই কাহিনীর উপযোগী করে বসাতে গিয়ে লেখক নিজের অজান্তেই তৈরি করে ফেলেছেন গিলটি মিয়া চরিত্রটিকে। চরিত্রটির বাচনভঙ্গি তিনি তাঁর মায়ের  থেকে পেয়েছেন, যিনি হুগলির মানুষ হলেও কলকাতা শহরে বড় হয়েছিলেন। তাঁরই  মুখের ভাষা একটু অদলবদল করে নিয়ে বসিয়ে দিয়েছেন গিলটি মিয়ার মুখে। বর্তমানে গিলটি মিয়া মাসুদ রানার রাইট হ্যান্ড । বিভিন্ন সময় ‘রানা এজেন্সি’র বিভিন্ন শাখার হেড হিসেবে দেখা যায় ।

কবির চৌধু্রী

কাজিদার সৃষ্টি কবির চৌধুরী রানা সিরিজের অন্যতম খল নায়ক। নিঃসন্দেহে পাগল বৈজ্ঞানিক কবির চৌধুরী রানার সবচেয়ে ক্ষমতাধর ও বিপদজ্জনক চিরশত্রু। শত্রু হলেও কবির চৌধুরি রানাকে শ্রদ্ধা করে ! কবির চৌধুরী বিজ্ঞান সাধনার জন্যে নিজের জীবন উতসর্গ করে। আশ্চর্যের ব্যাপার হল কবির চৌধুররী শুধুমাত্র টাকার বা ক্ষমতার লোভে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে নি। বরং বিজ্ঞানের উতকর্ষতার জন্যে গবেষণার টাকা যোগাতে বিসর্জন দেয় মানবিক নীতি, বিধিনিষেধ , সততা আর ন্যায়পরায়নতা।

মাথাভরা কোঁকড়ানো ঝাকড়া চুল আর কাঠের পা-অলা, রানার জীবনের চরমতম এই রাহুর আবিরভাব ঘটেছিল সিরিজের সর্বপ্রথম বই ‘ধবংস-পাহাড়’ –এ । এর পর কাজিদা কবির চৌধুরীকে সময়ে অসময়ে নিয়ে এসেছেন। কবীর চৌধুরী রানার জীবনের অন্যতম বড় আঘাতগুলোর জন্য দায়ী।

সেই ধ্বংস পাহাড়ে রানার সঙ্গে বিয়ে হতে যাওয়া সুলতা রায়কে চিরতরে কেড়ে নেয়ার পর মাসুদ রানার আরেক অবিস্মরণীয় প্রেম অনীতা গিলবারটকেও হারিয়েছিল সে চৌধুরীর হাতে । এমনকী মাসুদ রানার প্রায় অর্ধাঙ্গিনীতে পরিণত হওয়া সোহানা চৌধুরীও একসময় প্রায় মারাই গিয়েছিল কবীর চৌধুরীর জন্যে। অথচ এতসবের পরেও রানা স্বীকার করতে বাধ্য হয় কবীর চৌধুরীর অগাধ বুদ্ধিমত্তা-জ্ঞান-প্রজ্ঞাকে । কেবলই পথভ্রষ্ট হয়ে নিজ দেশের এতবড় একজন প্রতিভাকে ধ্বংসের পথে ক্রমাগত ধাবিত হতে দেখে নিদারুণ আক্ষেপও অনুভব করে ।

রানার বইয়ের মিছিলে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র আছে যাদের কথা উল্লেখ না করলেই নয়, তারা হচ্ছে, ববি মুরল্যান্ড, ভিন্সেন্ট গগল, গিল্টি মিয়া, রাঙার মা, সলিল সেন, নিশাত সহ আরও অনেকে। বিখ্যাত খল চরিতেরও অভাব নেই রানা সিরিজে। রানাকে বহু ভাবে ভোগানোর পরেও শেষ পর্যন্ত জিততে না পারলেও বার বার আরও ভয়ানক চাল নিয়ে ফিরে আশা সেই চরিত্রেদের মাঝে খায়রুল কবির (কবির চৌধুরীর ছেলে) উ সেন, গুস্তাফ, জ্যাক লেমন সহ অনেকে উল্লেখযোগ্য।

রানার সাথে অসংখ্য মেয়ের সখ্যতা গড়ে তুলে। রেবেকা সলের সঙ্গে রানার বিয়ে প্রায় হয়েই গিয়েছিল। ওদিকে ভারতনাট্যমেও মিত্রার গর্ভে রানার সন্তান আসার কথা আমরা জেনেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিয়ের পিঁড়িতে রানা বসেনি। তা বলে নারীদের সঙ্গ ত্যাগ করতে হয় না তাকে। বরং আর দশ জনের চেয়ে নারীদের সঙ্গে যেন একটু বেশিই ঘনিষ্ঠ রানা। তাদের মধ্যে সোহানাই বোধ হয় রানার সবচেয়ে কাছের, যাকে কোনো একদিন হয়তো সে বিয়ে করবে! এমনটাই রানার পাঠকদের ধারণা দেওয়া হয়েছে পুরো সিরিজে।

কাজী আনোয়ার হোসেনঃ মাসুদ রানার স্রষ্টা

নানা সময়ে পর্দায় মাসুদ রানা

পেপারব্যাকের বাদামী পৃষ্ঠার বাইরেও রানার পা পড়েছে চলচিত্রে। মাসুদ রানা চরিত্রটি নিয়ে বাংলাদেশে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয় মাসুদ রানা সিরিজের ১১ তম বই ‘বিস্মরণ’ অবলম্বনে, ১৯৭৩ সালে। আর ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৭৪ সালে। পরিচালনায় ছিলেন মাসুদ পারভেজ তথা পরবর্তীকালের জনপ্রিয় অভিনেতা সোহেল রানা। তার পরিচালিত প্রথম ছবি এটি।  বিশ বছরের বেশি সময় পর পরবর্তীকালে লেজার ভিশনের ব্যানারে এই চলচ্চিত্রটি ডিভিডি আকারে বাজারে আসে।

বাংলাদেশের টিভি নাটকের ইতিহাসে প্রথম প্যাকেজ নাটক প্রাচীর পেরিয়ে এর কাহিনী রচনা করা হয় কাজী আনোয়ার হোসেন রচিত মাসুদ রানা সিরিজের পিশাচ দ্বীপ নামক বই থেকে। কাহিনীর নাট্যরূপ প্রদান করেন আতিকুল হক চৌধুরী। ১৯৯৪ সালে প্রচারিত এই নাটকটিতে মাসুদ রানার ভূমিকায় অভিনয় করেন জনপ্রিয় মডেল তারকা নোবেল আর তার বিপরীতে সোহানার ভূমিকায় অভিনয় করেন বিপাশা হায়াত। খলনায়কের ভূমিকায় ছিলেন কে. এস. ফিরোজ।

এ দিকে ২০১৮ সালের মাঝামাঝি  কাজী আনোয়ার হোসেনের ‘মাসুদ রানা’ অবলম্বনে তিনটি ছবি নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়া।

প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার আবদুল আজিজ গ্লিটজকে বলেন,

“৬০, ৭০, ৮০, ৯০ দশকের বাংলাদেশের মানুষেরা বড় হয়েছে মাসুদ রানা পড়ে। এখনো বিশাল একটি জনগোষ্ঠী পড়ে মাসুদ রানা। এখনো নতুন মাসুদ রানার প্রথম এডিশনে ২০ হাজার কপি ছাপা হয়। এই দেশে এটি এখনো একটি অনেক বড় সংখ্যা। আমাদের নিজেদের কোন সুপার হিরো নেই, নেই সুপারম্যান, স্পাইডারম্যান। আমাদের কাছে সুপার হিরো মানেই মাসুদ রানা। তাই তাকে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে সচেষ্ট হয়েছি।”

তিনি আরও বলেন,

মূলত কাজীদা (কাজী আনোয়ার হোসেন) কাউকে মাসুদ রানা বানানোর জন্য রাইট দেন না, কারণ কেউ নাকি ঠিকমতো রানাকে উপস্থাপন করতে পারবে না। জাজ এর শুরুতেই একটা বই এর রাইট এর জন্য যোগাযোগ করা হলে, উনি রাইট দেয়নি। তবে শুভ সংবাদ হলো, এখন কাজীদা জাজের উপর আস্থা রেখেছেন। উনার বিশ্বাস জাজ ঠিক মত মাসুদ রানা বানাতে পারবে। এই জন্য প্রথমে উনার ৩টি বইয়ের রাইট দিয়েছে ৫ বছরের জন্য।”

সিনেমা বানাতে তাদের ভালই ঝক্কি-ঝামেলা পুহাতে হবে।ই শুটিং এর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো কাপ্তাই বাঁধের শুটিং এর পারমিশন পাওয়া । কারণ কাউকে কখনো কাপ্তাই বাঁধে শুটিং করতে দেওয়া হয়নি। এমনকি সেখানে জনসাধারণেরও প্রবেশাধিকার নেই।

তাছাড়া ১৯৬৫ সালে ধ্বংস পাহাড় রচনা হয়েছিল । তখনকার আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও প্রেক্ষাপট এখন থেকে ভিন্ন। তখন বাংলাদেশ পূর্ব পাকিস্তান ছিল আর ভারত কে শত্রু দেখান হয়েছে । ভারত পাগল বৈজ্ঞানিক কবির চৌধুরী সাথে মিলে, কাপ্তাই বাঁধ উড়িয়ে দিবে, যেদিন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট কাপ্তাই বাঁধে আসবেন । সেই বাঁধের সাথে প্রেসিডেন্ট ও ভেসে যাবে । কিন্ত ভারত এখন আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র তাই কাহিনী প্লট ঠিক রেখে নতুন করে গল্প সাজাতে হয়েছে।

প্রথম চলচ্চিত্রটি নির্মাণে জাজ মাল্টিমিডিয়ার প্রাথমিক বাজেট ৫ কোটি টাকা। জাজ মাল্টি মিডিয়া আশা প্রকাশ করছে ২০১৮ সালেই শুরু হচ্ছে মাসুদ রানা সিরিজের ধ্বংসপাহাড় অবলম্বনে প্রথম চলচ্চিত্রটি নির্মাণের কাজ।

তবে মাসুদ রানা চরিত্রে কে অভিনয় করবেন, সেটা এখনো ঠিক হয়নি। সেটা ঠিক করা হবে রিয়েলিটি শোর মাধ্যমে। রিয়েলিটি শো’র সঙ্গে যুক্ত আছে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ইউনিলিভার। রিয়েলিটি শো’তে নির্বাচিত তিন তরুণ অভিনয় করবেন মাসুদ রানা সিরিজের ‘ধ্বংস পাহাড়’, ‘ভারতনাট্যম’ ও ‘স্বর্ণমৃগ’ অবলম্বনে ৩টি চলচ্চিত্রে।

এদিকে ‘কে হবে মাসুদ রানা’ শোর একটি বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণ করেছেন অমিতাভ রেজা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ সাড়া ফেলেছে এটি।

এই রিয়েলিটি শোর আয়োজন করছে চ্যানেল আই। আর বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাছাই করার কাজটি করবেন বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের অন্যতম জনপ্রিয় নায়ক ফেরদৌস আর নায়িকা পূর্ণিমা।

শেষ কথা

পঞ্চাশ বছর ধরে দেশে দেশে ভয়ঙ্কর সব মিশন নিয়ে রানা আমাদের ঘুরিয়ে চলছে । কখনও ইসরাইলের নেগেভ মরুভূমিতে, কখনও সেন্ট পিটার্সবার্গে, মিশর বা পেরুর ইনকা সভ্যতার গুপ্তধন উদ্ধারে, আবার আফ্রিকার কোনো অত্যাচারী শাসকের অবসান ঘটাতে, কিংবা অ্যান্টার্কটিকায় কোনো প্রাচীন রহস্য উদঘাটনে – দুনিয়ার কোথায় রানা যায়নি?!

অনেক বই বিদেশী গল্পের অবলম্বনে লেখা হলেও একটি চরিত্রকে সব বইয়ে ফুটিয়ে তোলার যে ক্ষমত্‌ সেটি কাজী আনোয়ার হোসেন দেখিয়েছেন চমৎকার ভাবে। কোন মানুষ একই সাথে এত দক্ষ ভাষাবিদ, পর্বতারোহী, ডুবুরী, কম্পিউটার বিশারদ, ইতিহাসবিদ, শিকারি, যোদ্ধা, কূটনীতিবিদ, বৈমানিক, সাগরবিশেষজ্ঞ, ভূতাত্ত্বিক, অস্ত্রবিশারদ, রেসার ! এসব গুণে গুণান্বিত মাসুদ রানা । কিন্ত বাস্তবে মাসুদ রানা কি সম্ভব ? নাহ, হয়ত সম্ভব নয়। এর পরেও মাসুদ রানা আমাদের মাঝে শিহরণ তুলে । যুগ যুগ ধরে আমাদের  রানা বেঁচে থাকুক তার অদম্য সাহস, বুদ্ধি আর নৈতিকতা নিয়ে !

মানজুরুল হক