মুজিব নগর সরকারঃ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম শক্তিশালী ভিত্তি
মুজিবনগর সরকার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য গঠিত বাংলাদেশের প্রথম সরকার। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর ১০ এপ্রিল এ সরকার গঠিত হয়। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা গ্রামে মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহণ করে। আর এই সরকারের নেতৃত্বে পরিচালিত হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। ইতিহাসবিদ-গবেষকগণ এর মতে- স্বাধীনতা অর্জনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে এই সরকার গঠন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা এবং পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে দেশের জনগণের প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু হলেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য মুক্তিবাহিনী সংগঠন ও সমন্বয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায় এবং এই যুদ্ধে প্রত্যক্ষ সহায়তাকারী রাষ্ট্র ভারতের সরকার ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সাংগঠনিক সম্পর্ক রক্ষায় এই সরকারের ভূমিকা ছিল অপরিসীম।
মুজিবনগর সরকারের কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের মূল ভূ-খণ্ডের বাইরে থেকে পরিচালিত হয়েছিলো বলে এ সরকার ‘প্রবাসী মুজিবনগর সরকার’ হিসেবে খ্যাত। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল থেকে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত ছিলো মুজিবনগর সরকারের কার্যকাল।এই সরকার গঠনের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ প্রবল যুদ্ধে রূপ নেয় এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের বিজয় অর্জন গতিলাভ করে।
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে বাংলার যে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল তার ঠিক ২১৪ বছর পরে, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের মুজিবনগরের বাংলার সেই অস্তমিত স্বাধীনতার সূর্য আবারও উদিত হবার পথ সুগম হয়। তার ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডটি স্বাধীন দেশ হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে জায়গা নতুন করে স্থান দখল করে । পাকিস্তানের পরাজয়ের মূল ভিত্তি তৈরি হয়েছিল যেই মুজিব নগর সরকার গঠনের প্রেক্ষিতে।
পিছনের পথ
১৭ এপ্রিল আমাদের জীবনে আকস্মিকভাবে আসেনি। ‘৪৮, ‘৫২, ‘৫৪, ‘৬২, ‘৬৬, ‘৬৯, ‘৭০, এর পথ বেয়ে আসে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল। দীর্ঘকাল ব্রিটিশদের কাছে বন্দি থাকার পর বাঙালি ভেবেছিল মুক্তি মিলেছে তাদের। পরাধীনতার গ্লানি আর সইতে হবে না। কিন্তু না, তারা আবারও বন্দি হয়ে পড়ে পাকিস্তানি শাসকদের হাতে। সেই বন্দিত্ব থেকে মুক্তি পেতে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। তার ডাকে সারা দিয়ে জীবনবাজি রেখে মরণপণ লড়াই-সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল গোটা জাতি। দীর্ঘ আন্দোলনের জোয়ারে ধীরে ধীরে বাঙালির হৃদয়ে আঁকা হয়ে যায় একটি লাল-সবুজ পতাকা, একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের ছবি।
৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বাঙালি জাতির মুক্তিরদূত বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দিয়েছিলেন, ওই ভাষণেই ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ কথাটি উচ্চারণের মধ্য দিয়েই একটি স্বাধীন দেশের ঘোষণা করেছিলেন তিনি।
স্বাধীনতার ঘোষণা যে বঙ্গবন্ধু আগেই দিয়েছিলেন সেই বিষয়ে আরেকটি ঘটনার কথা বলা যেতে পারে। ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চ ঢাকা এসেছিলেন, তখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন,
‘বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের অংশ নয়। আর ইয়াহিয়া বিদেশি প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমাদের রাষ্ট্রীয় অতিথি’।
তার এই বক্তব্যের মধ্য দিয়েই তিনি বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে পরিচিত করিয়ে দেন। সে যাই হোক, ৭ই মার্চের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘোষণায় পাকিস্তানি শাসকচক্র দিশেহারা হয়ে যায়। প্রতিশোধ স্পৃহা জেগে ওঠে তাদের মাঝে। আর তাই ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদাররা শোষিত ও নির্যাতিত মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে রক্তের সমুদ্রে ভাসিয়ে দিতে শুরু করেছিল ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর গণহত্যা। মৃত্যু, ধ্বংস, আগুন আর আর্তনাদে বীভৎস হয়ে ওঠেছিল চারিদিক।
নীল নকশার মুল নায়ক পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অপারেশন সার্চ লাইট শুরুর আগে রাতের আঁধারে ঢাকা থেকে পালিয়ে যান । অপারেশনের মুল দায়িত্বে রেখে যান বেলুচিস্তানে ঈদের জামাতে মুসলমান হত্যাকারি কুখ্যাত লে. জেনারেল টিক্কা খানকে ।
পুর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক মধ্য রাতে ঘুমন্ত নিরস্ত্র বাঙালিদেরকে নির্বিচারে হত্যা করা হয় ।
একটি বিশেষ গ্রুপের (কমান্ড ) এক প্লাটুন সৈন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ি আক্রমণ করে ।
বাঙালি জাতিকে এমন পরিস্থিতিতে শত্রুর মোকাবেলা করে বিজয় ছিনিয়ে আনার জন্য বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট শুরু হবার পর পর ২৫ মার্চ দিবাগত রাত অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে ইপিআর এর একটি ছোট ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। । এর পরপরই তাকে বন্দি করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা ছিল নিম্নরূপ:
‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আমার আহবান, আপনারা যে যেখানেই থাকুন এবং যার যা কিছু আছে তা দিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার সেনাবাহিনীকে প্রতিহত করুন। বাংলাদেশের মাটি থেকে পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটি বিতাড়িত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদের এ লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।’ (http://bn.banglapedia.org/index.php?title=স্বাধীনতা_ঘোষণা )
এরপর ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র হতে মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষ হতে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। মূলত সেই দিন হতেই বহির্বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
‘আমি মেজর জিয়া, বাংলাদেশ লিবারেশন আর্মির অস্থায়ী প্রধান সেনাপতি এতদ্বারা শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।‘আমি আরও ঘোষণা করছি, আমরা ইতোমধ্যে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে একটি সার্বভৌম ও বৈধ সরকার গঠন করেছি, যে সরকার আইনবিধান ও শাসনতন্ত্র অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনায় অঙ্গীকারাবদ্ধ। নতুন গণতান্ত্রিক সরকার আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জোটনিরপেক্ষ নীতিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই সরকার সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার এবং আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করবে। আমি সকল দেশের সরকারকে বাংলাদেশে নৃশংস গণহত্যার বিরুদ্ধে তাদের নিজ নিজ দেশে জনমত গড়ে তোলার আহবান জানাই। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকার বাংলাদেশের সার্বভৌম ও বৈধ সরকার এবং এ সরকার বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক দেশের স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য।’ (http://bn.banglapedia.org/index.php?title=স্বাধীনতা_ঘোষণা )
বঙ্গবন্ধু দূরদর্শী নেতা ছিলেন। তাই তিনি একদিকে ওয়ারলেসে স্বাধীনতার ঘোষণা রেকর্ড করে রেখেছিলেন, তেমনি একটি সরকার গঠনের পরিকল্পনাও করেছিলেন। তার সেই পরিকল্পনা অনুযায়ীই পরবর্তিতে মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়েছিল।
এদিকে ২৫ মার্চের ভয়াবহ গণহত্যার সময় তৎকালীন আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রধান নেতা তাজউদ্দীন আহমদ নিজ বাসা ছেড়ে পালিয়ে যান। তখন তিনি বাংলাদেশ সরকার গঠনের পরিকল্পনা শুরু করেন। প্রথমে আত্মরক্ষা তারপর প্রস্তুতি এবং সর্বশেষে পালটা আক্রমণ এই নীতিকে সাংগঠনিক পথে পরিচালনার জন্য তিনি সরকার গঠনের চিন্তা করতে থাকেন।
বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ৩০ মার্চ সন্ধ্যায় তিনি ফরিদপুর-কুষ্টিয়া পথে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তে পৌছান । তাজউদ্দিন আহমদ ৩১ মার্চ ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামকে নিয়ে মেহেরপুর সীমান্ত দিয়ে ভারতে যান দেশের মানুষকে আত্মরক্ষা ও পাল্টা আক্রমণে ভারতের সাহায্য লাভের উদ্দেশে।
সীমান্ত অতিক্রম করতে মেহেরপুরের তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী তাদের সার্বিক সহায়তা করেন। সীমান্ত অতিক্রম করার পর সাক্ষাত হয় ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর তৎকালীন মহাপরিদর্শক গোলক মজুমদারের সাথে। গোলক মজুমদার তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে যথোপযুক্ত সম্মান প্রদর্শনপূর্বক তাদের নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন।
এ সময় গোলক মজুমদার তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের অবস্থানের খবর ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর মহাপরিচালক কেএফ রুস্তামজীকে অবহিত করেন। এ সময় মহাপরিচালক তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেন এবং পূর্ববাংলা সার্বিক পরিস্থিতি এবং বাঙালির স্বাধীনতা লাভের অদম্য স্পৃহা সম্পর্কে সম্যক অবগত হন।
এ সময় বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহী সেনাদের সমর্থনে ভারত সরকার থেকে নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত ভারতীয় সামরিক বাহিনী এবং সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সাহায্য করছিল না। তাজউদ্দিন আহমেদ মুক্তিফৌজ গঠনে বিএসএফ এর সাহায্য চাইলে তৎকালীন বিএসএফ প্রধান তাকে বলেন যে মুক্তিসেনাদের ট্রেনিং এবং অস্ত্র প্রদান সময় সাপেক্ষ কাজ এবং তিনি আরো উল্লেখ করেন যে ট্রেনিংয়ের বিষয়ে তখন পর্যন্ত ভারত সরকারের কোন নির্দেশ না থাকায় তিনি মুক্তিবাহিনীকে ট্রেনিং ও অস্ত্র দিতে পারবেন না।
এর পর কেএফ রুস্তামজী দিল্লিতে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযো করেন। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং তাজউদ্দীন আহমদের বৈঠকের জন্যে তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে নিয়ে দিল্লি যাওয়ার জন্য তাকে জানানো হয়।
দিল্লিতে পৌছানোর পর ভারত সরকার বিভিন্ন সূত্র থেকে নিশ্চিত হন যে, তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠতম সহকর্মী। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকের আগে ভারত সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাজউদ্দিন আহমদের কয়েক দফা বৈঠক হয় এবং তিনি তাদের বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনার জন্য যেসব সাহায্য ও সহযোগিতার প্রয়োজন তা বুঝিয়ে বলেন।
দিল্লিতে গিয়ে তাজউদ্দিন বুঝতে পারলেন, এভাবে কেবল আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে দেশের জন্য সহানুভূতি ও সমবেদনা ছাড়া তেমন কিছু তিনি আশা করতে পারেন না। ভারত সরকারের সাথে সম্পর্ক করতে একটি প্রতিষ্ঠিত সরকার খুব ভাল কাজে দিবে । এ ছাড়া সরকার গঠন ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ঐ সরকারের দৃঢ় সমর্থন ছাড়া বিশ্বের কোন দেশই বাংলাদেশের প্রতি সাহায্য বা সহযোগিতার হাত বাড়াবে না । এছাড়া ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকের আগের দিন এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাজউদ্দীনের কাছে জানতে চান যে স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে কোনো সরকার গঠিত হয়েছে কিনা। তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে বৈঠকে তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি রূপে নিজেকে তুলে ধরবেন।
তাই তিনি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকে জানান পাকিস্তানী আক্রমণ শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই ২৬ মার্চেই বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করে সরকার গঠন করা হয়েছে । শেখ মুজিব সেই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রেসিডেন্ট এবং মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকে যোগদানকারী সকল প্রবীণ সহকর্মীই মন্ত্রীসভার সদস্য। মুজিবের গ্রেফতার ছাড়া তখন পর্যন্ত দলের অন্যান্য প্রবীণ নেতাকর্মীর খবর অজানা থাকায় সমাবেত দলীয় প্রতিনিধিদের সাথে পরামর্শক্রমে দিল্লির উক্ত সভায় তাজউদ্দীন নিজেকে প্রধানমন্ত্রী রূপে তুলে ধরেন।
বৈঠকে তাজউদ্দীন আহমদ ইন্দিরা গান্ধীর কাছে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য অনুরোধ করেন। ইন্দিরা গান্ধী তাকে এই বলে আশ্বস্ত করেন যে, উপযুক্ত সময়ে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়া হবে। এভাবেই অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের ধারনার সূচনা। কলকাতায় ফিরে এসে তিনি সরকার গঠনের প্রস্তুতি নেন। কিন্তু দলের অভ্যন্তর থেকেই আসতে থাকে নানারকম বাধা।
আনুষ্ঠানিকভাবে মুজিব নগর সরকার গঠন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির সেনাবাহিনী ফ্রান্স দখল করে নিলে জেনারেল দ্য গলে লন্ডনে যেভাবে ফ্রান্সের প্রবাসী সরকার গঠন করেছিলেন, অনেকটা সেভাবেই বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে কলকাতায় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার গঠন করা হয় । এই সরকারের সাথে কম্বোডিয়ার প্রিন্স নরোদম সিহানুকের সরকার তুলনীয়। যার সাথে পলপটের খেমাররুজ যুক্ত ছিল। এদের সদর দপ্তর দীর্ঘকাল চীনের বেইজিংয়ে ছিল। কোনো কোনো সময় থাইল্যান্ডেও ছিল। সিহানুকের স্বাধীন কম্বোডিয়া সরকার একদিকে প্রবাসী ছিলেন অন্যদিকে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল তাদের দখলে ছিল, যেখানে তারা সরকার পরিচালনা করতেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মুজিব নগর সরকার বহুলাংশে এই সরকারের সঙ্গে তুলনীয়।
১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল শনিবার ভারতের আগরতলায় এক বৈঠকে ২৮ জন এম পির উপস্থিতিতে সর্বপ্রথম স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ঘোষণাপত্র জারি করা হয়। যা মুজিবনগর সরকারের ঘোষণাপত্র বলা হয়। এই সরকার বিপ্লবী সরকার বা অস্থায়ী সরকার বা প্রথম সরকার বা মুজিবনগর সরকার নামে পরিচিত। এবং পাকিস্তানি বাহিনীর নিয়ন্ত্রন মুক্ত কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তবর্তী শহর চুয়াডাঙা অথবা মেহেরপুর শহর কে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী ঘোষনা করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়। ঐ বৈঠকে ১৪ এপ্রিল অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ১০ই এপ্রিল মুজিব নগর সরকারের ঘোষণা দেওয়া হলেও পরের শনিবার ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠিত হয়।
কিন্তু এই গোপন সংবাদ বিদেশী সাংবাদিকরা জেনে ফেলায় দেখা দেয় বিপত্তি। আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে এ সংবাদ প্রচারের পর পরই চুয়াডাঙা শহর পাক বাহিনীর টার্গেটে পরিণত হয়। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর জঙ্গি বিমান থেকে চুয়াডাঙার উপর ব্যাপক ভাবে বোমা হামলা চালাতে থাকলে ১৫ এপ্রিল চুয়াডাঙা পাকিস্তানি বাহিনীর নিয়ন্ত্রনে চলে যায়। সে কারণে বাধ্য হয়েই শপথ গ্রহনের তারিখ ১৪ এপ্রিলের পরিবর্তে ১৭ এপ্রিল নির্ধারণ করা হয়।
আর স্থান নির্বাচন করা হয় মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলার আমা বাগান। এ দিন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধূ শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে গঠিত সরকারের শপথ গ্রহন অনুষ্ঠিত হয়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী হলেন তাজ উদ্দিন আহমেদ। ঐতিহাসিক এই আম্রকাননে দেশ-বিদেশের সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে এক অনাড়ম্বর অথচ মনোঞ্জ অনুষ্ঠানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী সভার সদস্যদেরকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়।
ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে অর্থ দপ্তরের মন্ত্রী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান কে স্বরাষ্ট্রÑএান ও পুনর্বাসন মন্ত্রী, খন্দকার মোস্তাক আহমদকে পররাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রী এবং এম এ জি ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়। চীপ অফ ষ্টাফ হিসেবে আবদুর রবের নাম ঘোষণা করা হয়।
এই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে দিনাজপুর হতে নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির চীপ হুইপ অধ্যাপক ইউছুফ আলী বিপলবী সরকার গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। এ সময় প্রায় শতাধিক দেশি- বিদেশী সাংবাদিক ও আশে পাশের এলাকার প্রায় হাজার পাঁচেক ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। নাতিদীর্ঘ এই অনুষ্ঠানে আনসার ও ই পি আর বাহিনীর দু টি পৃথক পালাটুনের কাছ থেকে প্রথমে উপ রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম অভিবাদন গ্রহন করেন। সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশিত হয়। এর পর পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করা হয়।
ঐ অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী উভয়েই বক্তব্য পেশ করেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তার ভাষণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেন। ভাষণের শেষাংশে তিনি বলেন,
বিশ্ববাসীর কাছে আমরা আমাদের বক্তব্য পেশ করলাম, বিশ্বের আর কোন জাতি আমাদের চেয়ে স্বীকৃতির বেশি দাবিদার হতে পারে না। কেননা, আর কোন জাতি আমাদের চাইতে কঠোরতর সংগ্রাম করেনি। অধিকতর ত্যাগ স্বীকার করেনি। জয়বাংলা।
প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমেদ কুষ্টিয়া জেলার মেহের পুর মহকুমার বৈদ্যনাথ তলার ভবেরপাড়া গ্রামের নাম পরিবর্তন করে মুজিবনগর নাম করন করেন। গার্ড অব অনারের নেতৃত্বে ছিলেন ঝিনাইদহের তৎকালীন এস ডি পি ও মাহবুব উদ্দিন আহমেদ। অনুষ্ঠানের স্থানীয় ব্যবস্থাপনায় ছিলেন মেহের পুরের তদানিন্তন এস ডি ও তৌফিক ই-এলাহী চৌধুরী। সামগ্রিক সহযোগিতায় ছিলেন ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের অধ্যাপক শফিকুললাহ। অনুষ্ঠান পরিচালনার সামগ্রিক দায়িত্বে ছিলেন টাংগাইল থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য এ্যাডঃ আবদুল মান্নান।
অস্থায়ী সরকারের গঠন
রাষ্ট্রপতি- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী)
উপরাষ্ট্রপতি- সৈয়দ নজরুল ইসলাম (রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন)
প্রধানমন্ত্রী- তাজউদ্দীন আহমদ
মন্ত্রণালয়সমূহের নাম
নং | মন্ত্রীর নাম | দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয় |
---|---|---|
১। | তাজউদ্দীন আহমদ | ১। প্রধানমন্ত্রী ২। প্রতিরক্ষা ৩। তথ্য ও বেতার এবং টেলিযোগাযোগ। ৪। অর্থনৈতিক বিষয়, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন ৫। শিক্ষা,স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন সরকার, স্বাস্থ্য, শ্রম ও সমাজকল্যাণ ৬। সংস্থাপন ও প্রশাসন ৭। যেসব বিষয়ের দায়িত্ব মন্ত্রিপরিষদের অন্য কোন সদস্যকে প্রদান করা হয়নি |
২। | খন্দকার মোশতাক আহমেদ | ৮। পররাষ্ট্র বিষয় ৯। আইন ও সংসদ বিষয় |
৩। | এম মনসুর আলী | ১০। অর্থ ও জাতীয় রাজস্ব ১১। বাণিজ্য ও শিল্প ১২। পরিবহণ |
৪। | এ এইচ এম কামারুজ্জামান | ১৩। স্বরাষ্ট্র বিষয়ক ১৪। সরবরাহ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন ১৫ কৃষি |
মন্ত্রণালয়ের বাইরে আরো কয়েকটি সংস্থা ছিল যারা সরাসরি মন্ত্রিপরিষদের কর্তৃত্বাধীনে কাজ করত। যেমনঃ
- - পরিকল্পনা কমিশন
- - শিল্প ও বাণিজ্য বোর্ড
- - নিয়ন্ত্রণ বোর্ড, যুব ও অভ্যর্থনা শিবির
- - ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটি
- - শরণার্থী কল্যাণ বোর্ড
এই মুজিবনগর সরকার যেন সঠিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারে তজ্জন্য সর্বদলীয উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়। ঐ কমিটিতে ছিলেন আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, মণি সিং, অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ, মনোরঞ্জন ধর, তাজউদ্দিন আহম্মদ, খন্দকার মোশতাক আহমেদ। এ ছাড়াও প্রশাসনিক কাঠামো ও বেসামরিক প্রশাসন গঠন করা হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধে সঠিকভাবে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল। সেক্টর কমান্ডার হলেন- (১) মেজর জিয়াউর রহমান, (২) মেজর খালেদ মোশারফ, (৩) মেজর কেএম শফিউল্লাহ, (৪) মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত, (৫) মেজর মীর শওকত আলী, (৬) উইংকমান্ডার এমকে বাশার, (৭) মেজর নাজমুল হক, সুবেদার মেজর এ রব, মেজর কাজী নুরুজ্জামান, (৮) মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, (৯) মেজর এম এ জলিল, (১০) নৌবাহিনীর ০৮ জন বাঙালি কর্মকর্তা, (১১) মেজর এম আবু তাহের।
উল্লেখ্য যে, ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হওয়ার পর ২৯ শে ডিসেম্বর মুজিবনগর সরকার পূনর্গঠিত হয়। যাহা ১৯৭২ সালের ১২ই জানুয়ারি পর্যন্ত বহাল ছিল। নতুন মন্ত্রী পরিষদে এসেছিলেন শেখ আব্দুল আজিজ, ফনীভূষণ মজুমদার, আব্দুস সামাজ আজাদ, জহুর আহমদ চৌধুরী, অধ্যাপক এম ইউসুফ আলী প্রমূখ।
এই মুজিব নগর সরকার গঠন হওয়ায় আন্তর্জাতিক বিশ্ব বাংলাদেশকে একের পর এক স্বীকৃতি দিতে থাকে। সর্ব প্রথম স্বীকৃতিদাতা দেশ হলো ভূটান ও ভারত। তারপর মঙ্গোলিয়া, পূর্ব জার্মানী, সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া), পোল্যান্ড, ইরাক, ইরান, বুলগেরিয়া, মিয়ানমার, নেপাল, সার্বিয়া, টোঙ্গা, চেক প্রজাতন্ত্র-এভাবে বাংলাদেশকে ১৫০টি দেশ স্বীকৃত দেয় এবং একই সাথে বিশ্বে এই মুজিবনগর সরকারের সঠিক নেতৃত্ব প্রশংসা কুড়িয়েছিল।
মুজিবনগর সরকার সর্বপ্রথম ২৭ শে ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অবিলম্বে মুক্তি প্রদানের দাবি জানায়। তারপর ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য পাকিস্তানের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, তিনি বাংলাদেশের স্থপতি।
কাজেই পাকিস্তানের কোন অধিকার নাই তাকে বন্দি করে রাখার। বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই বহু রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভ করেছে। ফলে বিশ্বচাপে শেষ পর্যন্ত ৮ই জানুয়ারি/৭২-এ পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। তৎপর বঙ্গবন্ধু লন্ডন-ভারত হয়ে ১০ই জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে পদার্পণ করেন। ১২ই জানুয়ারি তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন এবং তখন থেকেই মুজিবনগর সরকারের কার্যাদি শেষ হয়।
সরকার গঠনের গুরুত্ব
মুজিবনগর সরকার যদি গঠিত না হতো তাহলে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা যুদ্ধ প্রশ্নবিদ্ধ হতো। বিশ্ব জনমত ভিন্নখাতে প্রবাহিত হতো। আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশের পক্ষে স্বীকৃতি আদায়ে হিমশিম খেতে হতো।
পাকিস্তান সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি হতো না। মুক্তিযুদ্ধ সঠিকভাবে পরিচালিত হতো কিনা সন্দেহ ছিল। বঙ্গবন্ধু মুজিবকে আদৌ মুক্ত করা যেতো কিনা বলা মুসকিল ছিল। এজন্য রাজনৈতিক এবং ঐতিহাসিক দিক দিয়ে মুজিব নগর সরকার গঠন ছিল সময়োপযোগী সঠিক পদক্ষেপ।
শেষ কথা
আমাদের জন্য এই সরকার গঠন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং যুদ্ধের উপরে এর প্রভাব ছিল সুদুর প্রসারী। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়েই এটা ছিল বৈধ সরকার। ফলে বাংলাদেশের জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে যেকোনো ধরনের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার আইনানুগ ক্ষমতাও ছিল তাদের।
মুজিবনগর সরকার গঠিত না হলে আমরা আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদী অথবা বিদ্রোহী হয়ে পড়তাম। ফলে মুজিবনগর সরকারের বিভিন্ন কার্যাবলী পর্যালোচনা করলেই বোঝা যাবে কত ব্যাপক এবং সুসংগঠিত ছিল এই সরকারের কর্মসূচি এবং গঠন কাঠামো।